প্রধান প্রতিবেদক: সাম্য, দ্রোহ আর প্রেমের কবি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণ পুরুষ বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মজয়ন্তী আজ মঙ্গলবার।
১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারত থেকে ঢাকায় আসেন এবং তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিকতায় ও তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ২৪ মে (১৩৭৯ সনের ১০ জ্যৈষ্ঠ) কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়, বাংলাদেশ বিমানে করে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র আটদিন পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রাথমিক আমন্ত্রণ জানানো হয় ভারত সরকারকে। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এর মাত্র পাঁচদিন পর স্বামীর পক্ষে জোহরা তাজউদ্দীন এ আমন্ত্রণপত্র কবির কাছে পৌঁছে দেন। জবাবে কবি পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, শিগগিরই তিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন।
এর মাত্র দেড় মাস পরেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে যান ভারতে। অবস্থান করেন ১৯৭২ সালের ৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় পৌঁছেই বঙ্গবন্ধু কবির সুস্থতা কামনা করে তাকে দুইটি ফুলের তোড়া পাঠান। এরপরের দিন কবির দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ সস্ত্রীক রাজভবনে শেখ মুজিবুরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধু তার সরকারের পক্ষে নজরুলের পুত্রদের কাছে কবিকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দুই ভাই ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। এ সফরে তারা অসুস্থ কবিকে কীভাবে বাংলাদেশে আনা যায়, তা নিয়ে তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনতে কালক্ষেপণ করতে চাননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে কবিকে বাংলাদেশের আসার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের মধ্যে মার্চ ও এপ্রিল মাসজুড়ে চিঠি চালাচালি হয়। কবিকে ঢাকায় আনার জন্য কাজী সব্যসাচী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও আলোচনা করেন। সব কূটনৈতিক তৎপরতা শেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৭২ সালের ২৫ মে'র কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়, সেদিন সকালে কবির পুত্রবধূ তাকে গোসল করান। পরে সিল্কের নতুন পাঞ্জাবি ও ধুতি পরান। কবিকে খাইয়ে সোজা নিয়ে আসেন কলকাতা বিমানঘাঁটিতে। বিমানঘাঁটির নতুন আন্তর্জাতিক টার্মিনালে কবিকে বিদায় সংবর্ধনা জানাতে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধি, রাজ্য সরকারের লিয়াজোঁ অফিসার ও কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বিমানে কবির কোনো অসুবিধা না হলেও কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত কবি সম্পূর্ণ নীরব থাকেন।
ঢাকার চিত্র তখন উৎসবের মুখর। সকাল থেকেই কবিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে ভিড় জমাতে শুরু করেন তার অনুরাগীরা। বিমানবন্দর ভবনের ছাদ ও রানওয়ের একাংশ সকাল ১০টার মধ্যে অসংখ্যক মানুষে ভরে যায়। যারা এসেছিলেন তাদের প্রায় সবার হাতেই ছিলো ফুলের মালা। সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান ঢাকা বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়ে যায়। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি কোরবান আলী কবিকে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা জানান।
বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমান জনতা গণবিদারী স্লোগানে স্বাগত জানান চির বিদ্রোহীকে। নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে বিমানের চারপাশে ঘিরে ধরে জনতা। ফলে কবিকে বিমানের ভেতর থেকে বাইরে আনাটা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা পুলিশ ২০ মিনিট চেষ্টা করেও জনতাকে দূরে সরাতে পারেনি।
পরে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, কবি অত্যন্ত অসুস্থ। আপনাদের খুশি করার জন্য তবুও আমরা তাকে বাংলাদেশে এনেছি। এরপর বিমানের দরজা থেকে নামানো হয় কবিকে। পরে তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। চোখের দেখা দেখতে না পাওয়া জনতা ভালোবাসার অর্ঘ্য হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সের ওপর ফুল ছুঁড়তে থাকেন। সেখান তাকে সরাসরি ধানমন্ডিতে তার জন্যে নির্দিষ্ট বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানেও বিমানবন্দরের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। কবিকে এক নজর দেখতে বাড়ির সামনের আঙিনা, এক ফালি সবুজ লন, টানা বারান্দা সবখানেই ভিড় জমান অনুরাগীরা।
কবিকে ধানমন্ডির বাসভবনে নিয়ে আসার ঘণ্টাখানেক পরেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাকে দেখতে আসেন। কবি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি কবির শয্যার পাশে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে তিনি চলে যান। সে সময় তিনি মন্তব্য করেন, কবির ঢাকায় আগমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা চিরদিন স্মরণ করা হবে।
দুপুরে পর বিকেলে বঙ্গবন্ধু স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। বঙ্গবন্ধু সস্ত্রীক কবির কক্ষে ঢুকে তাকে শুয়ে থাকতে দেখেন। পরম শ্রদ্ধায় কবির মাথায় বঙ্গবন্ধু হাত রাখতেই তিনি চোখ মেলে তাকান। আবেগতাড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু সেময় বলেন, আমি এসেছি। আমি মুজিব এসেছি। আমি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।
পরদিন দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কবির সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবৃত্তি করেন, তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এর পরে কবি ঘোলাটে চোখে কবি শুধু একবার তাকান শেখ মুজিবুরের দিকে।
কবিকে সামনে রেখে ঢাকায় নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনের জন্য। বাংলাদেশে আসার পর কবির জন্য সরকারি উদ্যোগে পুরনো ২৮নং রোডের ৩৩০/বি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাড়িটি বরাদ্দ করা হয়। সেই সময়ে বাড়িটির নামকরণ করা হয় ‘কবিভবন’। সেখানে কবিকে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাদিতে ভূষিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ধানমণ্ডির বাড়িতে কবি কাটিয়েছেন তিন বছর এক মাস ২৯ দিন। কবিভবন থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় পিজি হাসপাতালের ১১৭নং কেবিনে। পিজি হাসপাতালে কবি মৃত্যু পর্যন্ত, অর্থাৎ ছয় মাস ১১ দিন কাটিয়েছেন।
জাতীয় পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে লেখা হয়। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভ, নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা সংক্রান্ত সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনো দলিল পাওয়া যায়নি। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংসদে আইন পাস করে এই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
এটা সত্য যে, সরকারি দলিলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশও প্রণীত হয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য স্বীকৃতি সংরক্ষণের বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২৫ মে ২০২১ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মজয়ন্তীতে। তার প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
সাননিউজ/টিএস/