মোহাম্মদ রুবেল: দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হেফাজত। চলছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু নেতাকে। এরসাথে নতুন যোগ হয়েছে বিএনপির চেয়্যারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রা ইস্যু।
যদিও খালেদার বিদেশযাত্রাকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনাপ্রবাহের কারণে কিছুটা ধামাচাপা পড়েছে হেফাজত ইস্যু। তবুও থেমে নেই হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে অভিযান। প্রশ্ন উঠেছে হেফাজতের তৎপরতা কি থিতিয়ে যাবে? নাকি মামলার খড়গ ঝুলিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রয়ণ করবে সরকার।
এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। এনিয়ে আওয়ামী লীগ বলছে, হেফাজতকে কোনোভাবেই ছাড় নয়। হেফাজতের যারা তাণ্ডব চালিয়েছে এবং দেশের বাইরে বসে যারা সংগঠনটির নেতাদের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে উসকানি দিচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ইন্টারপোলের সহায়তায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার সব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তৈরি হচ্ছে অপপ্রচারকারীদের তালিকা। আওয়ামী লীগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা সাননিউজ অনলাইন পোর্টালকে বলছেন, সারাদেশ গুজবের কারখানায় পরিণত হয়েছে। আর এই কারখানার রসদ জুগিয়েছে একটি কুচক্রী মহল। সর্বশেষ হেফাজত নেতা মামুনুল হকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজ ছড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে। তাই হেফাজতে এখন বিশ্বাস করতে চাইছে না সরকার। সাফকথা আর কোনো ছাড় নয় এ সংগঠনকে। তাই অতীতের সমঝোতার কৌশল থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। ভবিষ্যবতেও তাই করা হবে। এ প্রেক্ষিতেই হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চলমান গ্রেফতার অভিযান ও নজরদারি অব্যাহত থাকবে।
পুলিশ প্রশাসনের ভাষ্য, মামুনুল হক ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ইমেগ্রেশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গুজব রটানোর পাশাপাশি তাণ্ডব সফল করতে দেশের বাইরের অর্থের জোগানদাতাদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিটিবি শাখার মাধ্যমে সহায়তা নেয়া হচ্ছে ইন্টারপোলের। তাদের আর্থিক বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডি ও দুদকসহ সবাই কাজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনেককে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ অনলাইন নিউজ পোর্টাল সাননিউজকে বলেন, হেফাজতের দাবি অনুযায়ী তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়।আমরাও বলছি সম্প্রতি হেফাজত যে তান্ডব চালিয়েছে তা কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছিল না। তাদের কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক হলে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার প্রশ্ন আসতো। তাদের তো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। গুজব ছড়িয়ে তারা যেটা করছে পুরোটাই ছিলো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। তারা সন্ত্রাসী বলেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করেছে। তাই সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা চলে না। সন্ত্রাসীদের প্রশাসনিকভাবেই মোকাবেলা করতে হয়। তাই মামলা একটা নয়, ধর্মের নামে অধর্ম করে যারা নাশকতা ও জ্বালাও পোড়াও করেছে এবং এসবের সঙ্গে জড়িতদেরসহ নির্দেশ দাতাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। মামলাই শেষ নয়, আইনের আওতায় এনে এদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
এনিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিবৃতিতে তাণ্ডবে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগভাবে শাস্তি নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছেন।
অপরদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়েছে। সে কারণে মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতও বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে মাঠে নামার সাহস পাচ্ছে। যদিও হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে দাবি করে থাকে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা হেফাজতে রয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই অভিযোগ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দি ন নাছিম সাননিউজকে বলেন, পুলিশের তদন্তে বের হয়ে এসেছে হেফাজতের বর্তমান নেতাদের মধ্যে ৩০ ভাগ জামায়াত সংশ্লিষ্ট। আর ৩০ ভাগ আফগান মুজাহিদ এবং ৪০ ভাগ সত্যিকারের ধর্মীয় রাজনীতি করেন। এদের সংমিশ্রণে হেফাজত যে ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়েছে। শিশুদের তারা ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করছে। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাদের এত সহজে এদের ছাড় দেবো, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আইন আমরা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চাই না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের কাজ করবে। এদেরকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। আমরা মানুষকে সজাগ রাখার কাজ করছি।
তিনি বলেন,সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় চলমান অভিযানের ধারাবাহিকতায় বাকিরাও গ্রেফতারের মুখোমুখি হবেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছেন, দেশের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসত্য তথ্য ছড়িয়ে যারা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করা চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে ওলামা দলের এক নেতার করা ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।
লন্ডনে বসে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মনগড়া অসত্য তথ্যদাতা এ ব্যক্তির নাম মাহমুদুল হাসান শামীম। তিনি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক। অনলাইনে গুজব ছড়ানোর দায়ে রমনা থানায় তার নামে এরই মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাও হয়েছে।
গুজব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুজব সমাজের একেক শ্রেণির মানুষ একেকভাবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ গুজবে কান দেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতাও রুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে আবার রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব, সামাজিক বিশ্বাসযোগ্যতার উপরও নির্ভর করে।
তারা আরও বলছেন, কিছু কিছু গুজব নির্দিষ্ট কিছু দলের মানুষের মাধ্যমে দ্রুত ছড়ায় কারণ তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল, ধর্ম, মতামতের উপর বিশ্বাস করে এবং ওই সংক্রান্ত যেকোনো গুজবকে বিশ্বাস করে। একটি নির্দিষ্ট গুজব তখনই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যখন মানুষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তা মিলে যায়। এ কারণে একই গুজব গ্রামাঞ্চলে যতটা দ্রুত ছড়ায়শহরে হয়ত ততটা ছড়াবে না৷আবার গ্রামের মানুষের মধ্যে গুজবে বিশ্বাস অনেক দিন বাসবাস করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, গুজব সব সময়ই একটি সমস্যা। যেটা সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি হয়। এক্ষেত্রে যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে তাদের অনেক বেশি দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে হবে। এখানে নানা রকম মতামত আসবে। সব মতামতকে আমরা গ্রহণ করব না। কোনো একটা তথ্য পাওয়ার পর সেটাকে যাচাই বাছাই না করে বিশ্বাস করা যাবে না। এক্ষেত্রে মূলধারার গণমাধ্যমে যখন কোনো সমস্যা হবে তখনই মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে গুজব ছড়াবে এবং যারা এই গুজব ছড়াচ্ছে তারা এটা নিজেদের স্বার্থেই করবে জনস্বার্থে নয়। এছাড়া গুজব সৃষ্টি ও প্রচারকারীরা সুযোগ পেলে মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়া সব ক্ষেত্রেই এটা করবে। তবে গুজবের কার্যকারিতা বা প্রভাব বেশিক্ষণ থাকে না। এটা তৎক্ষণিকভাবে একটি প্রভাব সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মোদির সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন প্রতিবাদের জের ধরে ঢাকায় ব্যাপকভাবে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরবর্ততীতে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিক্ষোভের সময় চারজন নিহতের ঘটনাও ঘটে। এর পরের দুদিন সহিংসতা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে। এরমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। হামলা ও ভাঙচুর করা হয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এরই মধ্যে হেফাজতের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলে তাণ্ডবের ঘটনায়ও অনেক হেফাজতে ইসলামের নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। সেসব মামলায়ও গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির নেতাদের।
সাননিউজ/এমআর/আরআই