মোহাম্মদ রুবেল: আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও মন মানসিকতা ও চেতনায় হেফাজতি এমন নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরি করছে ক্ষমতাসীন দলটির বিশেষ সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা এসব হেফাজতি চেতনাধারীর সংখ্যা শতকরা ৩০ ভাগ বলে ইতোমধ্যে খুঁজে পেয়েছেন তারা। এরা জেলা-উপজেলা, নগর-মহানগর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও হেফাজতে ইসলামকে অন্ধের মতো সমর্থন দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হেফাজতের তান্ডবে তারই চিত্র ফুটে উঠেছে।
আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড এসব নেতাকর্মীদের অঙ্কুরেই শেষ করে দিতে চায়। দলের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো এরই মধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে। তৈরী হচ্ছে তালিকা। এরই মধ্যে সহযোগী সংগঠনগুলোতে পদে থাকা ১০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বাকীদের বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।
দলে হেফাজতি চেতনাধারীদের অবস্থান ও তাদের তালিকা তৈরি কতদূর জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা সাননিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের সাধারণত হাইব্রিড' ও ‘কাউয়া' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সম্প্রতি হেফাজত তান্ডবের মধ্যদিয়ে তৃতীয় ধারার উদ্ভব ঘটেছে। এরা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ কিন্তু চেতনায় হেফাজত। এরা যতই আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর কথা বলে চিৎকার করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সংকটের সময় হেফাজতের পক্ষ অবলম্বন করে। সম্প্রতি এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে সংগঠনকে দুর্বল করার জন্য।
নেতারা আরও বলছেন, বিগত ১২ বছরে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে এরা অনুপ্রবেশ করেছে। এদের অনুপ্রবেশে এখন তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি জামায়াতও খুঁজে পাওয়া যায় না ! কারণ এখন সবাই আওয়ামী লীগ ! পরিস্থিতি এমন যে আসল আওয়ামী লীগাররা তাদের কারণে দলে কোণঠাসা হয়ে পরেছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক সাননিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগে দলের মধ্যে বহু হাইব্রিড ও হেফাজত চেতনাধারী আওয়ামী লীগ নেতার উদ্ভব ঘটেছে। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের সময় দলের মধ্যে থেকে এ বর্ণচোরারা সংগঠন-বিরোধী কার্যকলাপে অংশ নিয়েছেন। আরও অনেকে ঘাপটি মেরে আছে। এদের চিহ্নিত করে অঙ্কুরেই শেষ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত ১২ বছরে হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘অতি সখ্যে’র কারণে দলটির অনেক নেতাকর্মী, এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও মগজও ধোলাই হয়ে গেছে। হেফাজতের পক্ষে আওয়ামী লীগের সাফাইয়ের কারণ হিসেবে ধর্মই ভোটের বিচারের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। মানে আওয়ামী লীগও ধর্মীয় আবেগের মোড়কে ভোটের হিসাব কষছে? না হলে কেন সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ মারজানের হেফাজত ও মাওলানা মামুনুল হকের পক্ষে পোস্ট ? কি করে পোস্ট দিয়েছেন ছাতক উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আলামীনও। ভেতরে থাকা এসব হেফাজত চেতনাধারী অনুসারীদের ভূমিকাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে আওয়ামী লীগ?
এক প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর কবির নানক সাননিউজকে বলেন, দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় যে কোনো মূল্যে দলের ভেতরে মামুনুল প্রীতিভাজনদের খুঁজে বের করতে জেলার নেতাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন এরই মধ্যে অনেক সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বহিষ্কৃত হয়েছেন। ভবিষ্যতে শুধু বহিষ্কারই নয় তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন সাননিউজকে বলেন, যারা ইসলামকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবেদী ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলে, তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। এদের সংখ্যা যাই হোক, এরা বর্ণচোরা। এরা ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সুযোগ বুঝে ছোবল মারে। হেফাজতের তাণ্ডবের সময় যারা দলের বিরুদ্ধে গিয়ে মামুনুলের পক্ষ নিয়ে বিশৃঙ্খলা করেছে। এদের চিহ্নিত করে তালিকা করার কাজ শুরু হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ তার লেখা বই “নিখোঁজ গণতন্ত্র: কর্তৃত্ববাদের পথরেখা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ’’ এ লিখেছেন , আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি দলটির বড় শক্তি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। অথচ সেই তৃণমূল আওয়ামী আর হেফাজত মিলেমিশে একাকার। অন্যভাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগ চেতনায় হেফাজতময়। যার প্রমাণ মিলেছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হেফাজত ও মামুনুলের পক্ষে সাফাইয়ের মধ্যদিয়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি একটানা এক যুগের বেশি সময় ধরে মসনদে আছে, সেই দলে এত হেফাজত আসল কোথা থেকে ?
তিনি বলেন, গত ১২ বছর আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজপথ ছাড়া করতে গিয়ে রাজপথটি তাদেরও হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের মাঠের রাজনীতি কোনো রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করছে না; করছে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
আলী রিয়াজ বলেন, এখন প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের, এমনকি ক্ষমতাসীন দলটির সম্পর্কও সুখকর নয়। এখন দেশে যা চলছে, তা প্রশাসনিক গণতন্ত্র। রাজনৈতিক ডেমোক্রেসি বলতে যা বুঝায়, তা নেই।
উধাহরন টেনে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রিসোর্ট ধ্বংসযজ্ঞ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুই ঘণ্টা অবস্থান করার পরও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কী করবে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি ইচ্ছা করেই হেফাজতের কর্মীদের আসার অপেক্ষায় ছিল? পরবর্তী সাতদিন পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গিয়ে হেফাজতের ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুলেছেন। কিন্তু কোন রাজনীতির হিসাবে-নিকাষে এতদিন তারা নিশ্চুপ ছিলেন ?
জানা গেছে, দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা বর্ণচোরা নেতাকর্মীদের উচ্ছেদের অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা আফজাল খানকে হেনস্তা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার ছেলে আল মুজাহিদ ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ওই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্রলীগ নেতাকে হেনস্তা ও অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় ধর্মপাশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে প্রত্যাহার করে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে ধর্মপাশা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনোয়ার হোসেনকে প্রত্যাহার করে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।
সুনামগঞ্জের শাল্লায় রফিকুল ইসলাম নামে যে ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে হামলা হলো, তিনি স্থানীয় যুবলীগের নেতা। আবার হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে যে তরুণ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি যুবদলের কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। বিএনপির কর্মীর স্ট্যাটাসের বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলমানেরা ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে যুবলীগের নেতা ও ইউপি সদস্য সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলায় নেতৃত্ব দিলেন।
সোনারগাঁয়ের ঘটনায় স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মামুনুল হককে নাজেহাল করে। আবার হেফাজতের কর্মীরা যখন তাদের তাড়া করে রিসোর্ট জবরদখল করে, তখন তারা এক সাংবাদিককে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। ক্ষমা চাওয়ার পরও তিনি রেহাই পাননি। হেফাজতের কর্মীরা তাকে বেদম প্রহার করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
অপরদিকে গত ২৯ মার্চ হেফাজতে ইসলামের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে স্বেচ্ছায় দল থেকে পদত্যাগ করেন হবিগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হেলাল উদ্দিন জনি, সদর উপজেলার ১০নং লস্করপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মহসিন আহমেদ মুন্না ও হবিগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হেফাজতে ইসলামের পক্ষে স্ট্যাটাস দেয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল রানাকে বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে ফেসবুকে ভাস্কর্য নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ায় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক খালেদ খান রবিনকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছিল সংগঠনটি।
সাননিউজ/এমআর/টিএস/বিএস