রাসেল মাহমুদ: 'গত ১৪ তারিখ থেকে কাজ নেই। হাতে টাকাও নেই। ৫ বছরের একটি ছেলে আছে। স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। প্রতিদিনই কিছু না কিছু লাগে। কিন্তু কাজ না থাকায় খাবার কেনার টাকাই জোগাড় করতে পারি না। স্ত্রী-সন্তানের অন্যান্য প্রয়োজন কীভাবে মিটাবো? সামনে ঈদ, অন্য কারও জন্য কিছু না হোক; বাচ্চাটার জন্যতো কিছু একটা কিনতে হবে। কিন্তু চোখে অন্ধকার দেখছি। এ কয়েকদিন চলছি ঋণ করে। কখনও একবেলা খাচ্ছি, কখনও না খেয়েই থাকছি। কিন্তু স্ত্রীর পরিচর্যা-ওষুধ তারতো টাকা লাগে। এই অবস্থায় শ্রমিক ইউনিয়ন-মালিক সমিতিও আমাদের পাশে নেই। আমরা ভাই সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ।'
কথাগুলো বলছিলেন মেট্রো সার্ভিস বলাকা পরিবহনের চালক মো. রুবেল হোসেন। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বিরস বদনে বসে থাকা রুবেলের সাথে কথা হয় সাননিউজের। তিনি জানান, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে গাড়ি চালান তিনি। কিন্তু চলমান লকডাউনে এসে যতোটা আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন গত লকডাউনেও ততোটা পড়েননি।
জানান, গত লকডাউনে মালিক পক্ষসহ বিভিন্ন সংগঠন নানারকম সহায়তা করেছে। এবার এখন পর্যন্ত কেউ কোনো খবর নেয়নি। এমনকি যে শ্রমিক ইউনিয়নে প্রতিমাসে তারা চাঁদা দেন তারাও কোনো খবর নেয়নি। রুবেলের অভিযোগ- আমাদের দেয়া অর্থে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা আলিশান বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছে। অথচ এই বিপদে কেউ খবর নেয় না।
একই টার্মিনালে কথা হয় বাস চালক মো. ইউনুস আলীর সাথে। তিনি বলেন, এই যে রোজার একটা মাস যাচ্ছে, এখনও বাসায় ভালো বাজার করতে পারিনি। ছোট বাচ্চাটা প্রতিদিনই ভালো খাবারের বায়না ধরে। কিন্তু দিনশেষে আমি বাসায় ফিরি খালি হাতে। নিজের সন্তানের কাছে নিজেই ছোট হয়ে থাকি। লকডাউন এসে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করেছে।
শুধু রুবেল কিংবা ইউনুস নন, চলমান লকডাউনে কাজ না থাকায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন পরিবহন খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল শ্রমিকই।
করোনার এই সময়ে বাস বন্ধ থাকায় অনেকেই রিকসা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মো. রুবেল। তিনি বলেন, পেটের দায়ে আমাদের অনেকেই রিকসা চালাচ্ছেন। অন্তত খেয়েতো বাঁচতে হবে।
তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। সায়েদাবাদ কেন্দ্রিক ব্যবসা করা আল মোবারাকা পরিবহন তার স্টাফদের এককালীন ৫০০ টাকা দিয়েছে এবং প্রতিদিন সেহরির ব্যবস্থা করছে। এই পরিবহনের চালক মো. মজিবুর রহমান সাননিউজকে বলেন, আমরাতো ডে লেবার। কাজ থাকলে আয় আছে কাজ না থাকলে আয় বন্ধ। এ অবস্থায় টিকে আছি শুধু আল্লাহর অশেষ রহমতে। তবে আমাদের মালিক সবাইকে ৫০০ টাকা করে দিয়েছে। একই সাথে সেহরির ব্যবস্থা করেছে।
লকডাউনে সুরমা পরিবহনের সুমন হোসেনের আয় একেবারেই বন্ধ হয়নি। তিনি টার্মিনালে গাড়ি পাহারা দেন। এরজন্য প্রতিদিন পান ১৫০ টাকা। এই টাকা দিয়েই তাকে চলতে হয়। সাননিউজকে তিনি বলেন, দেড়শো টাকায়তো ভাই চলে না। সারাদিন বাইরে থাকি। একগ্লাস পানি খেতে চাইলেও কিনে খেতে হয়। এখনো বিয়ে করিনি। একাই থাকি। তাই আল্লাহ কোনো রকম চালিয়ে নিচ্ছে।
আন্তজেলা বাস টার্মিনাল মহাখালী বাস টার্মিনালে কথা হয় দেলোয়ারের সঙ্গে। তিনি আলম এশিয়া পরিবহনের হেলপার। প্রতিদিন ৬০০ টাকা হাজিরায় কাজ করেন। সাননিউজকে জানান, লকডাউন শুরুর পর কাজ বন্ধ। তাই আয়ও বন্ধ। তবে মালিক পক্ষ তাদের কিছু সহযোগিতা করেছেন বলে জানান তিনি।
একতা পরিবহনের চালক রমিজ উদ্দিন বলেন, দেশের সবকিছু চলছে, তাতে করোনা বাড়ে না। কিন্তু গণপরিবহন চললেই করোনা বেড়ে যায়। দেশের দুই জায়গায় শুধু করোনা আছে। গণপরিবহন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আক্ষেপ করে রমিজ বলেন, সরকার যে লকডাউন দিয়েছে তা জনগণ আসলেই কি মানছে? মানুষের পেটে খাবার না থাকলে লকডাউন দিয়ে কোনো লাভ হয়?
তিনি জানান, বৃদ্ধ বাবা-মাসহ তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭ জন। করোনার পুরো সময়টা তিনি ঋণ করে চলেছেন। গাড়ি চালিয়ে যে টাকা জমিয়েছিলেন স্ত্রীর চিকিৎসায় তা ব্যয় হয়ে গেছে। লকডাউনের এ সময়ে তিনি স্ত্রীর ওষুধও ঠিক মতো কিনতে পারেননি।
সায়েদাবাদ টার্মিনালের শ্রমিকরা এবার কোনো সহায়তা না পেলেও মহাখালীর শ্রমিকরা কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন। এই সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও এনা ট্রান্সপোর্ট লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ সহায়তা দিয়েছেন। বিতরণ করা খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে চাল, আলু, তেল, ডাল ও পেঁয়াজ রয়েছে।
সাননিউজকে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, মহাখালীতে ১২০০ শ্রমিককে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। মিরপুর এবং গাবতলীতেও দেয়া হয়েছে। আমরা শ্রমিকদের কল্যাণে সব সময় পাশে আছি।
সাননিউজ/আরএম/টিএস/