নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার। ২০২০ এর মার্চ থেকে উদযাপন হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। স্বাধীনতার সুবণর্জয়ন্তী ইতিহাসের মহাকালের স্রোতস্বিনী আজ মহাসমুদ্রের দিকে ধাবিত। বাংলাদেশের কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর দুয়ার থেকে স্বাধীন দেশে ফিরে সাড়ে ৩ বছরের মাথায় মৃত্যুর হিমশীতল দেশে পাড়ি দিলেন।
মুজিব হলো রক্তবীজ, এক ফোঁটা থেকে লাখো-কোটির জন্ম হয়। তাই মুক্তিসেনায় দেশ ছেয়ে গেল মুজিবসেনার আগমনে। নেতা রেখে গেছেন দল যে দল বহু বাধাবিঘ্ন, বহু জনের দলত্যাগ-পিছু হটা, জবরদখল-বিপথগামিতা, লাগাতার হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, নিষেধাজ্ঞা-বিভক্তি সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে টিকে রইল, এগিয়ে চলল।
অবশেষে দলের হাল ধরার জন্য এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুরই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। কিন্তু আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আসতে পারল না; তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০৯ পর্যন্ত। সে অর্থে পঁচাত্তরের পরে আওয়ামী লীগ ঠিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ পেল ৩৪ বছর পরে। এবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে অনেকগুলো কাজে হাত দিলেন, যাতে পিতার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত স্বপ্নের দেশ সঠিক পথে যাত্রা করতে পারে।
প্রথমবার সরকার গঠন করার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার ও ফাঁসির আদেশ কার্যকর শুরু হয়েছিল। এবারে একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করলেন। হানাদার পাকিস্তানের অনেক চিহ্নিত দোসর, পরবর্তীতে জামায়াত মতাদর্শী অনেক শীর্ষ নেতা, যারা দেশটির জন্মের সঙ্গে বেইমানি করেও একদিন সেই দেশে ক্ষমতার মসনদে বসেছিল।
গাড়িতে উড়িয়েছিল লাল-সবুজের পতাকা, কলুষিত করেছিল স্মৃতিসৌধ, তাদের বিচার হলো, নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হলো। ইতিহাসের কলঙ্কমোচনে ও দায়মুক্তির দায়িত্ব পালন করে কাজ শেষ করলেন না নেত্রী। দেশগড়ার কাজেও আত্মনিয়োগ করলেন।
স্বাধীনতার সময়ে যে দেশ উন্নত বিশ্বের কাছে ছিল দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের পরিচয়ে উপেক্ষা ও উপহাসের পাত্র, যে দেশ চিহ্নিত হয়েছিল তলাবিহীন ঝুড়ি নামে, যে দেশের ভবিষৎ বলে কিছুই ছিল না তাদের বিবেচনায়, তার ভাবমূর্তি বদলের জন্য এবার কন্যার নেতৃত্বে আরেক রূপান্তরের কাজ হতে থাকল।
পঞ্চাশ বছর আগে গত শতকের ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির আশ্চর্য রূপান্তর ঘটেছিল ভীতু, ঘরকুনো, কলহপ্রবণ জাতি তার জাদুকরি নেতৃত্বের ছোঁয়ায় পরিণত হয়েছিল এক বীরের জাতিতে, যে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, অস্ত্র হাতে লড়াই করতে পিছপা হয় না, জান নিতে এবং দিতে পারে, নিজের কথা ছেড়ে দেশের কথা দশের কথা ভাবতে পারে।
যে ক্ষণকালের ভোগ ছেড়ে মহাকালের কঠিন দায় নিয়ে ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। সত্যিই এ ছিল প্রকৃত নেতার যথার্থ কাজ ইতিহাসের চাহিদা পূরণের জন্য এক অসংগঠিত অপ্রস্তুত জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করলেন, সংগঠিত করলেন। কিন্তু প্রত্যাঘাত আসতেও দেরি হয়নি, পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা চলেছে। ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, সংবিধান থেকে বাদ গেল ধর্মনিরপেক্ষতা, পাঠ্যবই ও গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তচিন্তা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও উদার মানবতার ঐতিহ্য নির্বাসিত হলো।
একসময় সংবিধানে যুক্ত হলো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সে অনুযায়ী উদারবাদী ও সংখ্যালঘুর ব্যবসা-বাণিজ্য-চাকরির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হলো, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সহজাত বিকাশের পথেও বিছানো হলো প্রতিবন্ধক। দুইটি দশক বাংলাদেশ সেনাশাসনের ও ছদ্মবেশী গণতন্ত্রের আড়ালে ধুঁকছিল। তার পর এলো বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়নের থাবা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরেনি, সমাজ জীবনে সুবাতাস আসেনি।
অবশেষে ২০০৯ সাল থেকে স্বাধীন দেশের আটকে যাওয়া চাকা ঘোরানো এবং রথটি সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কাজে নেতৃত্বে নামলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এবারেও যেন জাদুকরি ছোঁয়া লাগল। খাদ্যশস্যে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো; সবজি, ডিম, ফল, মাংস, মুরগির উৎপাদনে বাংলাদেশ নিজের চাহিদা পূরণে সক্ষম হলো।
খাদ্যাভাব অতীতের বিষয় হয়ে গেল, দারিদ্র্যের বৃত্ত ভাঙতে শুরু করেছে। উদ্যোক্তার সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গেল। মানুষের গড় আয়ু স্বাধীনতার সময় থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। মাথাপিছু আয় স্বাধীনতার সময় ছিল মাত্র ১৪২ ডলার, আর বর্তমানে তা পৌঁছেছে ২ হাজার ৬৪ ডলারে প্রায় দশগুণ বেড়েছে। শিক্ষার হার সত্তরের ঘরে পৌঁছেছে, প্রাথমিকে মেয়েরাসহ শতভাগ ভর্তি এখন নিশ্চিত হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটতে থাকল চারদিকে সেতু, সড়ক, উড়াল সেতু তৈরি হয়ে দেশে দ্রুতগামী যোগাযোগ নেটওয়ার্কও স্থাপিত হয়েছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে অনায়াসে স্টিল ও সিমেন্ট, দক্ষ জনবল ও জ্বালানি নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশই। রূপপুর, পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো, কর্ণফুলি টানেল, মাতারবাড়ী, পায়রা সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি মেগা প্রকল্পও কম তৈরি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভও রয়েছে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি। আর উন্নত বিশ্ব যখন করোনা মহামারীর প্রকোপে পর্যুদস্ত তখন বাংলাদেশ বিশ্বকে চমকিত করে দিয়ে এই রোগ সফলভাবে মোকাবিলা করে জনজীবন, অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখেছে। একদিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি নতুন জাতির জন্ম হয়েছিল, যারা ভয়ভীতি-দোলাচল কাটিয়ে বঞ্চনা, বৈষম্য, শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়েছেন যুদ্ধ করে, লাখোপ্রাণ বলি দিয়ে, অনেক নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে, অবশেষে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে।
এক যুগ আগে ছিন্নভিন্ন দিশাহীন জাতি পুনরায় আরেক জাদুকরি নেতৃত্বে উন্নয়নের পথে তথা আরেক রূপান্তরের পথে নির্ভীক পায়ে এগিয়ে চলেছে। ২০০৯ থেকে আমরা উন্নয়নের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি, একের পর এক মাইলফলকও পেরোচ্ছি, ছুঁয়ে যাচ্ছি। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের ধাপে পৌঁছব, ইশারা মিলছে উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছানোর।
২০২১-এর সুবর্ণজয়ন্তী সেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার স্বর্ণালি গাঁথা বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেবে এই আমাদের প্রত্যাশা।
সান নিউজ/এসএ