নিজস্ব প্রতিবেদক : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরে স্বাগত জানাতে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে ঢাকা। শুক্রবার (২৫ মার্চ) সকালে উপহার হিসেবে ১২ লাখ ডোজ করোনার টিকা নিয়ে দু’দিনের ঢাকা সফরে আসবেন মোদি।
এই সফরে দুই দেশের মধ্যে কমবেশি ৬টি সমাঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের উন্নয়নে এই সফরে একাধিক প্রকল্প উদ্বোধন করবেন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে ঘিরে একাধিক সংগঠন ‘নেতিবাচক’ মন্তব্য এবং আন্দোলন করছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, এসব আন্দোলন মোদির সফরে কোনো প্রভাব ফেলবে না এবং কোনো প্রকার নিরাপত্তা ঝুঁকিও সৃষ্টি করবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে আগামী ২৬ থেকে ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সফর করবেন। তিনি মূলত মুজিববর্ষ উদযাপন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ৫০ বছর যৌথ উদযাপন উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সফর করছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও বিভিন্ন দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে যোগ দেবেন।’
পানি নিয়ে সফরে কিছু হচ্ছে না : তিস্তা নদীর পানি বণ্টনসহ একাধিক নদীর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয় থাকলেও মোদির এই সফরে পানি ইস্যুতে কোনো অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা সেই।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত মাসে ভারতের পানিসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সচিব এখনও এই মন্ত্রণালয়ের সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল হতে পারেনি। তাই পানি ইস্যুতে এই সফরে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘এবারের সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন। চলমান করোনা সংক্রমণের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে বাংলাদেশ সফরে আসছেন এতেই আমরা আনন্দিত। এবারের সফরে পানি ইস্যুতে কোনো অগ্রগতি হবে না। তবে আমরা আশাবাদি যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পানিসংক্রান্ত অমিমাংসিত বিষয়ে সমাধান করতে পারব।’
চালু হচ্ছে স্বাধীনতা সড়ক : স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে মেহেরপুরের মুজিব নগরের সঙ্গে ভারতের নদীয়া জেলার সড়ক যোগাযোগ চালু হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর সফরে সড়কটি উদ্বোধন করা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মেহেরপুরের মুজিব নগরে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ভারতের ১৭টি গাড়ি আসে কলকাতা থেকে। ওই গাড়িগুলোতে আমাদের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা এবং আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমের সদস্যরা ছিলেন। ওইদিন তখন ওইখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছিল। একটা দুঃসময়ে বাংলার মাটিতে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেই, সার্বভৌম-স্বাধীনতার ওথ টেকিং হয়। এবং একটা সড়ক দিয়ে এরা সবাই কলকাতা থেকে সেদিন এসেছিলেন। সেই সড়কটা এই মেহেরপুর আর নদিয়ার সীমান্তে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এই সড়কটা বন্ধ কিন্তু এই সড়কটা আমাদের ঐতিহাসিক সড়ক। ভারতের দিকের সড়কটা চালু আছে, সেটা দিয়ে তারা কলকাতা যায়। আমাদের দিকেরটা বন্ধ, অল্প রাস্তা। এই সড়কটা এখন খুলে দিতে চাই। এই সড়কের নাম ঠিক করেছি স্বাধীনতা সড়ক। সড়কটি খুলে দিলে ভারত থেকে লোক আসবে, আমাদের এখানকার মানুষও সহজে ওইদিকে যেতে পারবে। আমাদের সৌহার্দ্য এবং মানুষে মানুষে সম্পর্ক আরও বাড়বে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এটা চালু হচ্ছে।’
প্রতিরক্ষা খাতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের ঘোষণা : নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিরক্ষা খাতের সরঞ্জাম ভারত থেকে ক্রয়ের বিষয়ে বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিবে নয়া দিল্লি।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ২৪ মার্চ নয়া দিল্লিতে এক প্রেস কনফারেন্সে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। এর আগে আমরা দুইদেশ মিলে প্রতিরক্ষা খাতের উন্নয়নে চুক্তি করেছি। যার আওতায় আমরা নিয়মিতভাবে যৌথ সেনা মহড়া, প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছি। এবার আমরা লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশকে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিবো, যাতে বাংলাদেশ ভারত থেকে প্রতিরক্ষা খাতের সরঞ্জাম কিনতে পারে।’
কমবেশি ৬টি সমাঝোতা : কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা সংরক্ষণ, বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি বিষয়ে কমবেশি ৬টি সমাঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটে চালু হচ্ছে রেলসেবা : নরেন্দ্র মোদির এই সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন একটি আন্তঃদেশীয় যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করা হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি রেল জংশন পর্যন্ত নীলফামারী জেলার চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটে চালানোর জন্য নতুন ট্রেনসেবাটি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।
পৃথক দু’টি স্মারক ডাকটিকিট : দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে নিজ নিজ দেশের পক্ষে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পৃথক দু’টি স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করবেন।
মোদীর সফরের সফরসূচি : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন। এসময় রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। এরপর নরেন্দ্র মোদি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবেন। একইদিন বিকেলে তিনি জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন। ওইদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনী পরিদর্শন করবেন।
সফরের দ্বিতীয় দিন, ২৭ মার্চ সকালে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ পরিদর্শন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। তাছাড়া, তিনি সাতক্ষীরা এবং গোপালগঞ্জে দু’টি মন্দির পরিদর্শন করে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মতবিনিময় করতে পারেন।
২৭ মার্চ বিকেলে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত বৈঠক ছাড়াও প্রতিনিধি পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হবে। বৈঠকের প্রান্তিকে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কিছু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সফর শেষে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৭ মার্চ রাতে দিল্লীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন।
সান নিউজ/এসএম