মোহাম্মদ রুবেল: ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাক-হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন
সার্চ লাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্বিচারে চালায় বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম এ গণহত্যা।
এ গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ড ছিল না, এটা ছিল এক কলংকজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র। যা দীর্ঘ নয়মাস পাকজান্তারা ক্লান্তহীন ভাবে চালিয়ে থাকে।
সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত্রি। এক ভয়াল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত এই রাত।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইনের ভাষায়, নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির উপর ২৫ মার্চ সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার হয় আরো ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। তৎকালীন সব পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট। আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।
প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছিল। এরপর থেকেই এই দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। তাই এ দিনটি উপলক্ষে প্রতিবারের মত এবারও একদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-
বৃহস্পতিবার গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া জাতীয় গণহত্যা দিবস স্মরণে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে নয়টা ১ মিনিট পর্যন্ত ১ মিনিটের জন্য জরুরি স্থাপনা ও চলমান যানবাহন ব্যতীত সারাদেশে প্রতীকী ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি পালিত হবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হবেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
২৫ মার্চ ভয়াল রাতে জেনারেল টিক্কা খানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালি হত্যার মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। পরিকল্পনার নীল নকশা বাস্তবায়নে ২৫ মার্চ পাক-হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালির উপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
সে প্রেক্ষিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চলতে থাকে ৯ মাস ধরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা। বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা পায় বাংলার ধ্রুবতারা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বলা হয়, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।
এদিন মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।
এদিন পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
সান নিউজ/এমআর/আরআই