মোহাম্মদ রুবেল : দলীয় প্রতীকেই থাকছে স্থানীয় সরকারের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন। চলমান পৌর নির্বাচনেও একই পন্থা বহাল থাকায় দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের দিনকে দিন বাড়ছে সংঘর্ষ-সংঘাত। তবুও রাজনৈতিক দলের প্রতীকেই আগামী ১১ এপ্রিল দেশের ৩২৩ ইউনিয়নে প্রথম ধাপে নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে।
ভোট এলেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এবং দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীরা সংঘাতে জড়িয়ে যান। কেন্দ্রের হুঁশিয়ারির পরও তাদের থামানো যায় না। ফলে তীব্র অন্তর্দলীয় কোন্দল এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের সামলাতে না পারায় ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। সারাদেশে এ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুইশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
আর এসব ঘটনার মূলে দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন হওয়াকে দায়ী করে স্থানীয় সরকার বিশেজ্ঞরা বলছেন, আসন্ন দলীয় প্রতীকের ইউপি ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, সংঘাতের মাত্রা তত বাড়বে। এছাড়া তৃণমূল আওয়ামী লীগে হাইব্রিড প্রার্থীরা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। ফলে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকে কেন্দ্রকরে সংঘাতের শঙ্কা থেকেই গেল।
ইসি সূত্রে জানা যায়, দলীয় প্রতীকেই দেশের ৩২৩ ইউপিতে প্রথম ধাপে আগামী ১১ এপ্রিল নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসব নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এর আগে দেশের তিন শতাধিক পৌরসভার মধ্যে পঞ্চম ধাপের ৩১টি পৌরসভায় ভোট হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি।
জানা যায়, তীব্র অন্তর্দলীয় কোন্দল ও বিদ্রোহী প্রার্থী সামলাতে আসন্ন ইউপি নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে করার চিন্তা হলেও আপাতত সেই ভাবনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য সাননিউজকে বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে স্থানীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক রাজনীতির ভিত্তি মজবুত হয়। তবে, আসন্ন ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকছে কি না এ নিয়ে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ধূম্রজালের বিস্তার ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ সাননিউজকে বলেন, যারা দলীয় প্রতীক তুলে দেয়ার আওয়াজ তুলছেন, তারা আসলে কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাজার যাচাই-বাছাই করছেন? কেননা জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় দলটির নেতারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না।
তিনি বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে কিছুটা ঝামেলা থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেন। দলীয় প্রতীক তুলে দিতে আমাদের দলের কিছু নেতাকর্মী বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের মতামত দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সাননিউজকে বলেন, সাড়ে ৪ হাজারের বেশি ইউপির জন্য চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী বাছাই ও নিয়ন্ত্রণ করা সব রাজনৈতিক দলের জন্যই কঠিন। ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের জন্য আরও কঠিন। সদ্যসমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল সংখ্যায় বিদ্রোহী প্রার্থী সামাল দিতে হয়েছে। আর দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে তৃণমূলে সংঘাতের ঝুঁকিও থেকে যায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারই ব্রিটিশ রাজনীতির অনুকরণে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। ওই বছরের ১৩ অক্টোবর দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন করার আইন অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। একই বছরের ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন দিয়েই শুরু হয় দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে প্রথম স্থানীয় নির্বাচন। এরপর ২০১৬ সালের মার্চে শুরু হওয়া দেশের ৪ হাজারের বেশি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয় রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীকে। আর তখন থেকেই রাজনীতির তৃণমূলে পেশিশক্তির চর্চা নতুন রূপ লাভ করে।
গেল বুধবার ইসির বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা জানিয়েছিলেন, প্রতীক পরিবর্তনের জন্য আইন পাস করার সুযোগ আপাতত নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও দলীয় প্রতীকেই ভোট করতে চাচ্ছে। এখনই দলীয় প্রতীক থেকে সরে আসার কথা ভাবছেন না তারা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন দলীয় মনোনয়নকে অনেকটা দায়ী করে সাননিউজকে বলেন, স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হলে সংঘাত এড়ানো যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ কোনো রাজনৈতিক দলই এ বিষয়ে একমত হতে পারছে না। বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কিন্তু এ দলটিও এ নিয়ে দ্বিধায় ভূগছে।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন না হলে সংঘাত কমে যাবে, এ প্রশ্নের উত্তরে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলে অনাকাঙ্খিত সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে না। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাশিত দলীয় মনোনয়ন প্রার্থীরা মনে করেন, মনোনয়ন পেলেই নিশ্চিত বিজয়। কিন্তু কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। এতে আবার নিজ দলের অনেকেই দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সাননিউজকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নির্বাচনে জিতে আসা। এমন লোভে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাই বাড়ে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সর্বগ্রাসী। বাড়ে সহিংসতার ঘটনা। আমি বলব, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নির্দলীয় করা উচিত। এতে ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটবে।
তিনি বলেন, দলীয় কারণে শুধু মারামারিই হচ্ছে না, এর মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠান চরমভাবে কলুষিত হচ্ছে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের প্রতিযোগিতা হয়। আবার মনোনয়ন বঞ্চিতরা দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান। এতে সংঘাতের সৃষ্টি হয় এবং নানা সমস্যায়ও পড়তে হয় দলকে। আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছোট-খাটো ঝামেলা হলেও দলীয় প্রতীকে ভোটগ্রহণ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বরং প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হলে মাঠপর্যায়ে গড়ে ওঠা সাংগঠনিক ভিত তৈরি হয়। সংসদ নির্বাচনে ইতিবাচক ফল দেয়। যার সুফল আওয়ামী লীগ পেয়েছে। তাই নিকট ভবিষ্যতে দলীয় প্রতীক তুলে দেয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ সাননিউজকে বলেন, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক তুলে দেয়া হবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত দলীয় ফোরামে হয়নি।
প্রথম ধাপে যেসব ইউপিতে নির্বাচন হবে: পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার ৩, বাউফলের ৬, দশমিনার ৩ ও গলাচিপার ৬; বরিশাল সদরের ৮, বাকেরগঞ্জের ১১, উজিরপুরের ৬, মুলাদীর ৬, মেহেন্দিগঞ্জের ৫, বাবুগঞ্জের ৪, গৌরনদীর ৭, হিজলার ৪, আগৈলঝাড়ার ৬ ও বানারীপাড়ার ৭; বরগুনার সদরের ৯, আমতলীর ৬, বেতাগীর ৭, বামনার ৪ ও পাথরঘাটার ৭; পিরোজপুর সদরের ৪, ভাণ্ডারিয়ার ৫, ইন্দুরকানির ১, মঠবাড়িয়ার ৬, নেছারাবাদের ১০, কাউখালীর ২ ও নাজিরপুরের ৪; ঝালকাঠি সদরের ৯, নলছিটির ১০, রাজাপুরের ৬ ও কাঁঠালিয়ার ৬; ভোলা সদরের ২, দৌলতখানের ৫, বোরহানউদ্দিনের ২, তজুমদ্দিনের ৩ ও চরফ্যাশনের ৭; খুলনার ডুমুরিয়ার ১৪, কয়রার ৭, দাকোপের ৯, বটিয়াঘাটার ৩ ও দিঘলিয়ার ৬; বাগেরহাট সদরের ৯, ফকিরহাটের ৭, মোল্লাহাটের ৬, চিতলমারীর ৭, কচুয়ার ৭, রামপালের ১০, মোংলার ৬, মোরেলগঞ্জের ১৬ ও শরণখোলার ৪; সাতক্ষীরা সদরের ১২, কলারোয়ার ১০, তালার ১১, দেবহাটার ৪, কালীগঞ্জের ১২ ও শ্যামনগরের ৭; রংপুরের পীরগাছার ১ ও পীরগঞ্জের ৪; কুড়িগ্রামের চররাজিবপুরের ৩; দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের ৬; বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার ১; ঢাকার দোহারের ৫ ও কেরানীগঞ্জের ৭; মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের ৮; নরসিংদীর পলাশের ২; গাজীপুরের কালীগঞ্জের ৭; টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ১১; মাদারীপুর সদরের ৮ ও শিবপুরের ১৩; মৌলভীবাজারের জুড়ির ১; সুনামগঞ্জের ছাতকের ৬; চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ১; চাঁদপুরের হাইমচরের ১; লক্ষ্মীপুরের রামগতির ২ ও কমলনগরের ৩; নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ৬ ও হাতিয়ার ৭ এবং কক্সবাজারের পেকুয়ার ১, মহেষখালীর ৩, কুতুবদিয়ার ৬ ও টেকনাফের ৫টি।
সাননিউজ/এমআর/টিএস/এম