মাহমুদুল আলম: লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম (পাপুল) সপদে বহাল থাকতে পারবেন কিনা- এই নিয়ে রাজনৈতিক এবং আইন-আদালত অঙ্গণে চলছে বিস্তর আলোচনা। বিদেশের আদালতে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে এখন একাডেমিক আলোচানও হচ্ছে গুরুত্বের সঙ্গে।
এই আলোচনায় জিজ্ঞাসা ও মন্তব্য আসছে মূলত দুটি বিষয়ে: একটি হচ্ছে- দণ্ড যেহেতু বিদেশের আদালতে হয়েছে, সেহেতু দেশে এটি এক্সিকিউট হবে কিনা। সোজাসাপ্টা বললে, বিদেশের মাটিতে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে একজন এমপিকে দেশে সংসদ সদস্য পদ হারাতে হবে কিনা? আর আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যদি হারাতেই হয় সেটির প্রক্রিয়া কী হবে?
মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে এমপি পাপুলের চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে কুয়েতের আদালতে। গত ২৮ জানুয়ারি কুয়েতের ফৌজদারি আদালতে বাংলাদেশের এই সাংসদের বিরুদ্ধে রায়টি হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ (২)(ঘ) অনুচ্ছেদে, কোন সংসদ সদস্য যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন এবং ন্যূনতম দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ার কথা বলা আছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার মুহম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার সান নিউজকে বলেন, দেশের আদালতে হোক আর বিদেশের আদালতে হোক সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে। তবে বিদেশের আদালতে যেহেতু হয়েছে, সেহেতু এটি বিদেশ থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দেশে আসতে হবে। আসার পর আদালতে উপস্থাপন করে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য দেশের আদালতের অনুমোদন নিতে হবে।
জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, বিদেশি আদালতের দেয়া এই রায়ের কারণে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিলের প্রক্রিয়ায় যেতে দেশের আদালতের অনুমতি পেলেই পরবর্তী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে।
এদিকে বিদেশের মাটিতে এই সংসদ সদস্য দণ্ডিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদের স্পিকার ও আইনমন্ত্রী বলেছেন, রায়ের কপি পেলে সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, বিষয়টিকে 'লজ্জার' বলেছেন।
বাংলাদেশের এমপি পাপুলকে গত বছরের ৬ জুন মানবপাচার, ভিসা জালিয়াতি ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করে কুয়েতের পুলিশ। সে দেশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা তার বিরুদ্ধে মানবপাচার ও প্রায় ৫৩ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (প্রায় এক হাজার ৪শ' কোটি টাকা) পাচারের বিষয়ে তথ্য প্রমাণ পায়।
তাছাড়া তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করে কুয়েতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর পাপুলের মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। দ্রুত বিচার শেষে পাপুলের সাজা হয়। পাশাপাশি তার কাজে সহায়তাকারী হিসেবে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা মাজেন আল জাররাহসহ সে দেশের দুই কর্মকর্তাকেও চার বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।
কুয়েতে পাপুল মানব ও মুদ্রাপাচারের মামলায় আটক হওয়ার পর থেকেই তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের সম্পদের অনুসন্ধান চলছে। এ পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণও পেয়েছে দুদক। এ অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে সংস্থার পক্ষ থেকে। এছাড়া জব্দ করা হয়েছে ব্যাংক হিসাব।
এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের পদের বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, এমপি পদ সাংবিধানিক। সেক্ষেত্রে সংবিধানেই ঠিক করে দেয়া আছে, যদি সংসদ সদস্য নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন, তার পদ থাকবে কি-না। রায়ের কপি পেলে সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্য পাপুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমরা তো শুধু কাগজপত্রে (সংবাদমাধ্যমে) জানতে পেরেছি। এখনো আদেশ বা সেই রায়ের অনুলিপি কিন্তু আমরা পাইনি। আমরা এখন রায়ের কপি পাওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেব। কপি পাওয়ার পর অবশ্যই স্পিকার সাংবিধানিক ব্যবস্থা নেবেন, যদি তিনি আপিল করে দণ্ড স্থগিত করতে না পারেন। কিন্তু আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত কাগজপত্র না পাচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত কাগজপত্র সংরক্ষণ করার চেষ্টা করবো, এর বেশিকিছু আপাতত বলতে পারছি না।
৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, আপনারা জানেন উনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন না, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছিলেন। এটা খুবই দুঃখজনক, অবশ্যই এটা দুঃখজনক, লজ্জাজনক ব্যাপার।
মোমেন বলেন, রায়ের বিষয়ে কুয়েত সরকার আমাদের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। বিষয়টা তারা আমাদের সরকারিভাবে জানালে পরে আমরা সংসদকে জানাব। তখন বিধি মোতাবেক উনার সম্পর্কে কী করা হবে, দেখা যাবে।
গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, এটা দুঃখজনক ঘটনা। সংসদ সদস্য পদ তো থাকবে না। তবে কুয়েতে বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তিনি দেশের আইন মন্ত্রণালয়কে জানালেই স্পিকার ব্যবস্থা নেবেন। আমরা পত্রপত্রিকা থেকে জেনেছি কুয়েতে এমপি শহিদ ইসলাম পাপুলের সাজা হয়েছে। এক্ষেত্রে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল করার বিষয় পদক্ষেপ নিতে রায়ের কপি আসতে হবে না।
সান নিউজ/এমএ/এসএস