হাসনাত শাহীন : করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট অতিমারীর প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বের অনেক কিছুই বদলে গেছে। ঘটছে-অনেক চিরন্তনী নিয়মের ব্যতিক্রমও। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তারই এক উদাহরণ ২০২১ সালের প্রাণেরমেলা বইমেলার আয়োজন। একুশের চেতনার সঙ্গে জড়িত যে আয়োজন ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়; সেই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ এবার হচ্ছে বাঙালির মুক্তিচেতানার জাগ্রত ‘মার্চ’ মাসের ১৮ তারিখ থেকে।
তবুও নানান জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বইমেলা তো হচ্ছে এটাই প্রশান্তির। আর এই প্রশান্তির খবরে এখন দেশের কবি-লেখক-পাঠক-প্রকাশক থেকে শুরু করে বইপ্রেমি সাধারণ মানুষরাও যারপরনাই উৎফুল্ল। এ নিয়েই এখন চলছে নানান আলাপ-আলোচনা। যার প্রধানতম আলোচনার বিষয় এবারের মেলায় সরকারের বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা। যে কারণে প্রকাশকরা এবার প্রায় অর্ধেক দামে স্টল ও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পাচ্ছেন।
কিন্তু পাঠকরা কি পাচ্ছেন? -আগের ২৫% কমিশনের চেয়ে এবার কি একটু বেশি কমিশনে বই কিনতে পারবেন? পাঠকরাও তো বৈশ্বিক মহামারী করোনায় কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। অনেকে অর্থ সংকটের কারণে এবার বই কেনা তো দূরের কথা মেলা প্রাঙ্গণেই আসতে পারবেন না! যে কারণে- মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির উচিৎ ‘বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহনকারী সকল ধরনের প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে যে কোন প্রকার শিক্ষার্থী ও সাধারণ পাঠকদের জন্য নূন্যতম ৩৫% কমিশনে সহজলোভ্যে বই কেনার সুযোগ করে দেওয়া।
এই বিষয়ে কথা হয় সাংবাদিক নজরুল কবীর ও সময়ের অন্যতম সেরা প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টুর সঙ্গে। নজরুল কবীর সান নিউজকে বলেন, একেতো করোনাকাল। তারপরে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। এবারের বইমেলার গুরুত্ব তাই অন্যান্যবারের তুলনায় অনেক ভিন্ন এবং গভীর আবেগের। এই মেলাকে ঘিরে তাই- বাংলা একাডেমির উচিত ‘বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহনকারী সকল ধরনের প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে শিক্ষার্থী ও সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজলভ্যে বই কেনার সুযোগ করে দেওয়া।
শিল্পী চারু পিন্টু জানান, সারাবছর প্রকাশকরা বিভিন্ন মাধ্যমের কাছে পাইকারি ৩৫% থেকে ৪০% বা তারও বেশি কমিশনে বই বিক্রি করে থাকে। তাহলে, এবারের এই করোনাকবলিত মেলায় সবধরণের পাঠকদের কাছে ৩৫% কমিশনে বই বিক্রি করলে তো কোন সমস্যা আমি দেখি না। বরং, আমি মনে করি-প্রকাশকরা করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরকারের প্রণোদনা পেল, আর প্রকাশকরা যদি পাঠকদের জন্য এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়; তাহলে পাঠকরা অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে বই কিনতে পারবে। ফলে বই বিক্রি বাড়বে এবং প্রকাশকদেরও বেশি লাভ হবে।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, এটা ঠিক যে, করোনার কারণে পাঠকরাও তো নানাভাবে ভুগছে। পাঠকরা এমন দাবি করতেই পারে। কিন্তু, প্রকাশকরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সারাবছর তারা তেমন বই বিক্রি করতে পারে নি। সেই জন্য তারা সরকারের কাছে প্রণোদনা দাবি করেছিল। সরকার সেই প্রণোদনা দিয়েছে।
সংস্কৃতি মন্ত্রাণালয়ের পক্ষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী মহোদয় আমাদের জানিয়েছেন যে, প্রকাশকদের কাছে থেকে এবার স্টল ও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দের টাকাটা অর্ধেক বা তার কিছু কম বেশি নিতে। বাকি টাকাটা মন্ত্রণালয় বাংলা একাডেমিকে প্রদান করবে। এটার সঙ্গে বই বিক্রির এই বিষয়টি যুক্ত হয়নি। যে কারণে, প্রতিবছর মেলায় যে হারে বই বিক্রি করা হয় এবারও সেই হারেই বই বিক্রি করার সিদ্ধান্তই বহাল আছে।
তিনি আরও বলেন, গত ২৭ জানুয়ারি বইমেলা আয়োজন সক্রান্ত সভায় এবারের বইমেলার যে নীতিমালা প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে তাতেও প্রতিবছরের মতো ২৫% ছাড়ে বই বিক্রির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ কারণে প্রকাশকদের এমন কোন শর্ত দেওয়া হয়নি যে, আপনাদের স্টল-প্যাভিলিয়নের মূল্য ছাড় দেওয়া হয়েছে; আপনারা পাঠকদের জন্য বইয়ের মূল্যে আরও বেশি ছাড় দেন। এটা আমরা (বাংলা একাডেমি) এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতেও পারি না। পাঠকরা যদি দাবি তোলে তাহলে-সরকার, প্রকাশক সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
করোনার কারণে অর্ধেকমূল্যে এবারের মেলায় আপনারা স্টল ও প্যাভিলিয়ন পাচ্ছেন। যেসব পাঠকরা বইমেলায় বই কেনে তারাও তো কোন না কোনভাবে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ। আপনাদের বিষয়তো সরকার আমলে নিয়েছে। তাদের বিষয়ে আপনারা কি চিন্তা করছেন? আপনারা কি এবারও আগের মত ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করবেন নাকি কমিশন বাড়াবেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, কমিশন তো আমরা বরাবরই ২৫% দিয়ে আসছি। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়, কারণ বই বিক্রির ক্ষেত্রে বিশ্বের কোথাও কমিশন দেওয়ার নজির নেই। কমিশন ছাড়া কিভাবে বই বিক্রি করা যায় আমরা তা নিয়েই চিন্তা করছি। এবারের করোনাকালীন বইমেলার সময় নিয়ে কমিশন বাড়ানো এবং কমানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমরা কিছু ভাবছিনা। প্রতিবছর ২৫% কমিশন হারে যেভাবে বই বিক্রি হয় আমরা এখনও সেই ধারাতেই আছি।
তিনি বলেন, করোনার কারণে অন্যান্য সেক্টরের মতো আমরা প্রকাশকরাও ক্ষতিগ্রস্থ। যেহেতু সারাবছর কোন বই বিক্রি করতে পারিনি তাই প্রণোদনা চেয়ে সরকারের কাছে আমরা আবেদন করেছিলাম এবং স্টল ও প্যাভিলিয়ন বিনামূল্যে বরাদ্দের জন্য দাবি জানিয়েছিলাম। সেই বিষয়ের বিবেচনায় সরকার আমাদেরকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষ্যে সরকার আমাদেরকে ৫০% ছাড়ে বইমেলার স্টল ও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দিচ্ছে। আপনার কাছে এই প্রথম কমিশন বাড়ানো-কমানোর বিষয়ে শুনলাম। বিষয়টি আমি সমিতির মিটিংয়ে উত্থাপন করবো। তারপর জানাতে পারবো আমরা কতটুকু কি করতে পারবো।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির ঢাকা মহানগরের সভাপতি ও অন্য প্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমরা এমনিতেই করোনার জন্য অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি, সারাবছর বই বিক্রি করতে পারিনি। তারপরে এবারের বইমেলাটি শুরু হতে যাচ্ছে বৈরি আবহাওয়ার সময়ে। ঝড়-ঝাপটাসহ নানা প্রতিকূলতা নিয়েই আমরা বেশি চিন্তিত। বইমেলার বই বিক্রির কমিশন নিয়ে আমরা এখনও কোন চিন্তা করিনি।
তিনি বলেন, আপাতত আমরা আগের ধারাবাহিকতাই বজায় রাখতে চাচ্ছি। কেন না নানা ধরণের পাঠক আছে তাদের সবার কিন্তু এক অবস্থা নয়। করোনার কারণে সবাই কিন্তু সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থও হয়নি। সুতরাং বইমেলায় বই বিক্রির জন্য নতুন করে কমিশন বাড়ানো বা কমানোর বিষয়ে আমরা কোন চিন্তা করছিনা।
এ বিষয়ে কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার বলেন, প্রকাশকদের মধ্যে চিন্তার সৃজনশীলতা থাকলে এই প্রসঙ্গে আলোচনারই দরকার হতো না। তারা তো দেশের মানুষের পরিস্থিতি জানেন। করোনা লক্ষ লক্ষ নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষকে প্রায় নিঃস্ব বানিয়েছে। আমাদের দেশের মূল বইক্রেতা এই নিম্ন-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষরা; সেইসাথে ছাত্র সমাজ। নিজেদের সকাল বা বিকালের টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে কিংবা দুএকবেলা অভুক্ত থেকে মেলার সময় একটি-দুটি বই কেনেন তারা। করোনার পরে সেই ছাত্রছাত্রীদের ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারবেন কি অভিভাবকরা? -এর উত্তরটা প্রকাশকরা জানেন।
কিন্তু যদি আন্তরিকভাবে চিন্তা করেন তাহলে এই পাঠকসমাজের জন্য বাড়তি কমিশনের ব্যবস্থা তারা অবশ্যই করবেন। তবে যেসব প্রকাশকের লক্ষ্য থাকে সরকারি আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে নিজেদের বই গছিয়ে দিয়ে কোটি টাকা কামানো, তারা একথা কানে তুলবেন না। আমি চাই ছাত্রছাত্রীদের জন্য ৩৫% কমিশনে এবারের বইমেলায় বই বিক্রি করা হোক।
সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক স্বকৃত নোমান বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এবারের বইমেলা পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছেনা। বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে মার্চে। এর মধ্য দিয়ে সরকার ও বাংলা একাডেমি আমাদের প্রাণের আকাঙ্খা পূরণ করছে। আমরা চেয়েছিলাম মেলাটা হোক। কারণ বইমেলা শুধুমাত্র বই বিক্রির ব্যাপার নয়, এটি আমাদের জাতীয় উৎসব এবং বৃহত্তর সংস্কৃতির একটি অংশ বলেই আমি মনে করি।
প্রকাশকদের প্রণোদনা দিয়ে সরকার একটা ভালো কাজ করেছে। আগে যে প্যাভিলিয়নটি ১ লক্ষ ৩২ হাজার টাকায় ছিল এবার সেটির মূল্য নেমে এসেছে মাত্র ৩৬ হাজারে। আর এক ইউনিটের যে স্টলটি আগে ১৩ হাজার ২শ টাকা ছিল এবার সেটির মূল্য মাত্র ৬ হাজার ৬শ টাকা। এটি প্রকাশকদের জন্য ইতিবাচক। সরকারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। একইসঙ্গে আমরা মনে করি প্রকাশকদেরও উচিত পাঠকদের প্রণোদনা দেওয়া। যে বইটি অন্যবারের মেলায় পাঠকরা ২৫% কমিশনে কিনতো এবার সেই বইটি যেন পাঠকরা ৩৫% কমিশনে কিনতে পারে।
সান নিউজ/এইচএস/এসএ