নিজস্ব প্রতিবেদক : দুর্লভ তো বটেই, অতি মূল্যবান ‘নাসার কয়েন’ বেচাকেনার মাধ্যমে রাতারাতি কয়েকটি কোটি টাকা লাভ হবে। এমন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারক চক্র কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
পিবিআইয়ের হাতে ধরা পড়ার পর প্রতারক চক্রের সদস্যরা জানিয়েছে ভয়াবহ প্রতারণার কাহিনী।
এই প্রতারক চক্র এই বলে প্রলোভন দেখাতো যে, এটি একটি নাসার কয়েন। গবেষণার কাজে কয়েনটি নাসায় ব্যবহৃত হয়। এটি কিনে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা যাবে। যার ক্রয়মূল্য ১০ কোটি টাকা। মার্কিন মুলুকে কয়েনটির ব্যাপক চাহিদা। এটি কিনে নেয়ার জন্য তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
কোটি কোটি টাকা লাভের আশায় দেশের একজন শিল্পপতি ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। খুইয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। পরে জানতে পারেন ‘নাসার কয়েনটি’ কাঠের তৈরি একটি মুদ্রা।
পিবিআই বলছে, এই কয়েনের কি এক তেলেসমাতি! যার জন্য কেন মানুষ টাকা দিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে? সর্বশান্ত হওয়ার আগে কেউ প্রতারণার বিষয়টি বুঝতেই পারছে না।
সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সম্প্রতি এই কয়েনের টোপে সরকারের প্রথম শ্রেণির এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার পেনশনের ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন প্রতারকদের হাতে। আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খুইয়েছেন ৮৪ লাখ টাকা। স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ী ২ কোটি টাকা দিয়েছেন, আরও টাকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন।
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, গত ডিসেম্বরে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান এই প্রতারকদের হাতে নগদ দেড় কোটি টাকা তুলে দেন। আরো টাকা দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে প্রতারণার বিষয়টি ধারণা করেন। পরে এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলার তদন্তে একটি কয়েন ঘিরে মহাপ্রতারণার এই তথ্য জানতে পারে পিবিআই।
পরে তদন্তের ধারাবাহিকতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-আক্তারুজ্জামান, সালাম, মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, আবু তাহের জবা ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। এদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি কাঠের কয়েন, নগদ ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করা হয়।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান এই চক্রের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন। বারীর সঙ্গে আবু তাহের জবার সম্পর্ক ছিল। তিনি নিজেকে বড় ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিতেন। তার দেশে-বিদেশে নিয়মিত যাতায়াত বলে জানান। কিন্তু প্রতারকদের মূল হোতা আদলে এসএসসি পাস। আগে নিজ বাড়িতে কৃষি কাজ করতেন।
জবার সঙ্গে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানের পরিচয় হয় বছর খানেক আগে। পরিচয়ের এক পর্যায়ে প্রতারক জামান বলেন, দেশের সীমান্ত এলকার বাসিন্দা সালাম নামে একজনের কাছে একটি কয়েন আছে। কয়েনটি নাসায় গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। জামান নামে একজন আমেরিকান ক্রেতাও আছে যিনি কয়েনটি কিনবেন। কিন্তু মূল্যবান এই কয়েন কেনাবেচায় মিলিয়ন ডলারের লেনদেন। তাই তিনি আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে চান। এজন্য তিনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা কমিশন পাবেন।
এর মধ্যে ক্রেতা মনিরুজ্জামান কামরুল জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন জবা। জামানের সঙ্গে নাসা, সিআইএ কিংবা ইউএস অ্যাম্বাসির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান। আসলে জামান একজন শাড়ি ব্যবসায়ী। স্বপন জামানের পিএ হিসেবে পরিচয় দিতেন। জামান ওই অমূল্য কয়েনটি কিনবেন আর লেনদেনে ব্যবহার করবেন আনন্দ গ্রুপের অ্যাকাউন্ট।
প্রতারক আক্তারুজ্জামান সীমান্ত এলাকায় থাকেন, তিনি বিক্রেতা খোঁজেন। ভারতের এমন কেউ নাই যে তাকে চেনে না! আসলে তিনি এইচএসসি পাস আর ঝিনাইদহের একটা বাড়িতে কেয়ার টেকারের চাকরি করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৯ ডিসেম্বর আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে অমূল্য ওই কয়েন দেখান। তার সামনেই বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে কয়েনটি পরীক্ষা করে দেখানো হয়। একপর্যায়ে কয়েনের পাসওয়ার্ড নিতে ভারতে ফোন দেওয়া হয়। হিন্দিতে কথা বলে পাসওয়ার্ড নেওয়া হয়। এককথায় বিশ্বাস স্থাপনের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করতে থাকে প্রতারকরা।
একপর্যায়ে কয়েনের দাম ঠিক হয় ১০ কোটি টাকা। এ সময় ক্রেতা জামান তাৎক্ষণিক সাড়ে আট কোটি টাকার চেক দেয়। প্রলোভনে পড়ে নগদ বাকি দেড় কোটি টাকা দিয়ে দেয় আনন্দ গ্রুপ। কিছুদিন পর কোনোভাবে তারা প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে আইনের আশ্রয় নেয়।
বনজ কুমার বলেন, চট্টগ্রামের এক বড় ব্যবসায়ী এই কয়েনের প্রলোভনে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন। আরও টাকা দিবেন বুঝতে পেরে তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আটকে রাখেন তার জামাতা। তার জামাতাও চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ী। কোনোভাবে তার শ্বশুরকে আরও টাকা দিতে আটকাতে না পেরে আমাদেরকে জানায়। পরে আমরা বিমানবন্দর থেকে আমাদের গাড়িতে করে ওই ব্যবসায়ীকে অফিসে নিয়ে আসি। তিনি প্রতারকদের টাকা দিতে এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, যে বাসায় যেতে পারলে আবার টাকা দেবেন।
সান নিউজ/আরআই