নিজস্ব প্রতিবেদক : ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ১৩ হাজার এককরের বুকে গড়ে উঠা অট্টালিকা আজ বাবুই চড়ুইদের ঠিকানার বড়াই। এই বড়াই উপহার হিসেবে তুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা রজনীকান্ত সেনের কবিতার বাবই-চড়ইদের মতো ভূমিহীন ও গৃহহীন ৬৯ হাজার পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই। অসহায় মানুষেরা পেলো স্বপ্নের ঘর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকে আমার অত্যন্ত আনন্দের দিন, ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর প্রদান করতে পারা বড় আনন্দের দিন।
তিনি বলেন, কোনো লোক গৃহহারা থাকবে না। মুজিববর্ষে আমাদের লক্ষ্য—একটি মানুষও ঠিকানাবিহীন থাকবে না, গৃহহারা থাকবে না। যতটুকু পারি, হয়তো আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, তাই হয়তো সীমিত আকারে আমরা করে দিচ্ছি। তাও যাই হোক একটা ঠিকানা আমি সব মানুষের জন্য করে দেব।
শনিবার সকাল ১০ টায় এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারী ভাসবহন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন ঠিকানাবিহীন মানুষের আশ্রয়স্থল। তারা পেল পাকা ঘর এবং দুই শতাংশ করে খাস জমি। এপ্রাপ্তিতে জেগে উঠলো বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্নে, জীবনের নতুন সংগ্রামে।
অনুষ্ঠনে এসে প্রধানমন্ত্রী জানালেন আমার খুব আকাঙ্ক্ষা ছিল, নিজ হাতে আপনাদের জমির দলিল তুলে দেই। কিন্তু করোরাভাইরাসের কারনে তার আকাঙ্খার অপূর্ণতাই রয়েগেলো।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, আমি বিশ্বাস করি, যখন এই মানুষগুলো ঘরে থাকবে, আমার মা-বাবা যাঁরা সারা জীবন এই দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে। লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে।
আশ্রয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সব স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর আমরা দিচ্ছি। এই ৬৬ হাজার ঘর এত অল্প সময়ের মধ্যে করা অত সহজ কথা নয়। যারা প্রশাসনে আছেন, সরাসরি আপনারা এই ঘরগুলো তৈরি করেছেন বলেই এটা করা সম্ভব হয়েছে এবং মানসম্মত হয়েছে। এ জন্য আমি সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের সরকারি কর্মচারীরা যেভাবে সবসময় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন, এটা অতুলনীয়।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এদেশের কোনো শ্রেণির মানুষ কিন্তু বাদ যাচ্ছে না। বেদে শ্রেণিকে আমরা ঘর করে দিচ্ছি, তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। হিজরাদের আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি, তাদেরও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দলিত শ্রেণি বা হরিজন শ্রেণি, তাদের ভালো মানের ফ্ল্যাট করে দিচ্ছি, চা শ্রমিকদের জন্য করেছি। প্রত্যেক শ্রেণির মানুষের জন্য কাজ করে দিচ্ছি, যেন সবাই মানসম্মতভাবে বাঁচতে পারে।
আরো এক লাখ ঘরের কাজ শিগগিরই শুরু হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুজিববর্ষে অনেক কর্মসূচি আমাদের ছিল, সেগুলো করোনার কারণে আমরা করতে পারিনি। করোনা আমাদের জন্য যেমন অভিশাপ নিয়ে এসেছে, তেমনই একদিকে আশীর্বাদও। কারণ আমরা একটি কাজের দিকেই নজর দিতে পেরেছি। আজ এটাই আমাদের বড় উৎসব যে গৃহহীন, ভূমিহীন মানুষকে আমরা ঘর দিতে পারলাম। এর চেয়ে বড় আর কোনো উৎসব বাংলাদেশে হতে পারে না।’
সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে আবাসন সুবিধার আওতায় আনার জন্য সরকারি কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে আরো এক লাখ বাড়ি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, গৃহ ও ভূমিহীন মানুষের মাঝে হস্তান্তরের জন্য সরকার বিশ্বে প্রমবারের মতো ৬৬ হাজার ১৮৯টি বাড়ি নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেছে। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নোয়াখালী জেলার (বর্তমানে লক্ষ্মীপুর) চরপোরাগাছা গ্রাম পরিদর্শনকালে ভূমিহীন, গৃহহীন ও অসহায় লোকদের পুনর্বাসনের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।’
মুখ্য সচিব বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও দেশের জন্য কল্যাণমুখী ও উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করেন।
সরকার মুজিব বর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য এক হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৬ হাজার ১৮৯টি বাড়ি নির্মাণ করেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অধীন আশ্রয়ন প্রকল্প মুজিব বর্ষ উদযাপনকালে ২১টি জেলায় ৩৬টি উপজেলায় ৪৪টি প্রকল্পের অধীনে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণ করে তিন হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করছে।
আশ্রয়ন-২-এর প্রকল্প পরিচালক মো. মাহাবুব হোসেন বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্প ২০২০ সালে আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা তৈরি করে। তাদের মধ্যে দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার এবং পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি পরিবারের এক থেকে ১০ শতাংশ ভূমি রয়েছে। তবে তাদের বসবাসের বাড়ি নেই।
মাহাবুব হোসেন আরো জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্প ১৯৯৭ সালে থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন লাখ ২০ হাজার ৫৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করেছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য ব্যারাক নির্মাণ করছে।
ড. কায়কাউস আরো বলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প চার হাজার ৮৪০.২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে (জুলাই ২০১০ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত) দুই লাখ ৫০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার ও ছিন্নমূল পরিবারকে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সারা দেশে এক লাখ ৯২ হাজার ২২৭টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে এরই মধ্যে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৪৮ হাজার ৫০০ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এক লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৭টি পরিবারের প্রত্যেকের এক থেকে ১০ শতাংশ ভূমি রয়েছে। কিন্তু তাদের বাড়ি করার সক্ষমতা নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু কক্সবাজারের খুরুশকুলে ৬০০ পরিবারের জন্য ২০টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ডিটেইল্ড প্রজেক্ট প্রপোজালের (ডিপিপি) মাধ্যমে আরো ১১৯টি বহুতল ভবন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছে।
সান নিউজ/এমআর/এম