নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলা একাডেমি ও চ্যানেল আইয়ে সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন।
ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সকাল ১১টায় রাবেয়া খাতুনের মরদেহ নেয়া হয় বাংলা একাডেমিতে। সেখানকার নজরুল মঞ্চের বেদিতে মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গণের বিশিষ্টজনেরা। ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দুইঘন্টা ব্যাপির এই শ্রদ্ধাঞ্জলী পর্বে শ্রদ্ধা জানান- তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান, মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন রাবেয়া খাতুন। অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও চার শতাধিক গল্প লিখেছেন তিনি। এমন একজন লেখিকার চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তারচেয়ে বড় কথা, তিনি যেই সময়ে সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন, সেসময়ে নারীদের ক্ষেত্রে সেটা খুব সহজ ছিলো না। বাংলা সাহিত্যে রাবেয়া খাতুনের মতো খুব বেশি লেখিকা পাওয়া যাবে না, তার প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। প্রার্থনা করছি, তার আত্মা যেন শান্তি পায়।
বাংলা একাডেমিতে শ্রদ্ধাঞ্জলী শেষে মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন-প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক এবং লেখিকার বড় জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্রুপের আরেক পরিচালক রিয়াজ আহমেদ খানসহ চ্যানেল আই পরিবারের সদস্য ও রাবেয়া খাতুনের শুভাকাঙ্খীরা।
পরিবারের পক্ষে লেখিকার বড় জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু রাবেয়া খাতুনের আত্মার শান্তি কামনায় সকলের কাছে দোয়া চান। জানাযা শেষে জানানো হয় আগামী ৮ জানুয়ারি বাদ জুম্মা চ্যানেল আই মসজিদে রাবেয়া খাতুনের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দেয়া অনুষ্ঠিত হবে। বাদ আছর বনানী কবরস্থানে রাবেয়া খাতুনের দাফন সম্পন্ন হয়।
স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত রাবেয়া খাতুন রবিবার ৩ জানুয়ারি ২০২১ বিকালে বাধ্যর্কজনিত কারণে বনানীর নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি দীর্ঘদিন যাবত বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড ও চ্যানেল আই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, ফরহাদুর রেজা প্রবাল, কেকা ফেরদৌসী ও ফারহানা কাকলীসহ চার সন্তান ও বহু গুণগ্রাহি রেখে গেছেন।
সাহিত্যের সব শাখায় ছিল রাবেয়া খাতুনের সদর্প বিচরণ। নিজের শৈল্পিক লেখনীর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন মহয়সী এই নারী। তিনি ১৯৩৫ সালে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতাও করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক, সিনেমা পত্রিকা ছাড়াও তার নিজস্ব সম্পাদনায় পঞ্চাশ দশকে বের হতো ‘অঙ্গনা’ নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথাসহ চলচ্চিত্র ও নাট্য জগতেও নিজেকে বিচরণ করেছেন রাবেয়া খাতুন। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মেঘের পরে মেঘ’ জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্র। ‘মধুমতি’ এবং ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ সর্বমহলে বেশ প্রসংশিত হয়। লেখালেখির পাশাপাশি বাংলা একাডেমি, চলচ্চিত্র জুরি বোর্ড, লেডিস ক্লাব, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, মহিলা সমিতিসহ অসংখ্য সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন রাবেয়া খাতুন। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই প্রয়াত এটিএম ফজলুল হকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রাবেয়া খাতুন। স্বামী প্রয়াত এটিএম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রথম পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক ও দেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ এর পরিচালকও তিনি।
ছোটগল্প দিয়ে শুরু হলেও লেখক পরিচয়ে প্রথমত রাবেয়া খাতুন একজন শক্তিমান উপন্যাসিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। তার রচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছেÑউপন্যাস, গবেষণাধর্মী রচনা, ছোটগল্প, ধর্মীয় কাহিনী, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। রেডিও, টিভিতে প্রচারিত হয়েছে তার লেখা অসংখ্য নাটক, জীবন্তিকা ও ধারাবাহিক নাটক। তার গল্পে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কয়েকটি।
রাবেয়া খাতুন উপন্যাস লিখেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি। এ পর্যন্ত চার খন্ডে সংকলিত ছোটগল্প সংখ্যায় চারশ’র বেশি। ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসও সংখ্যায় কম নয়। রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের ভ্রমণ সাহিত্যের প্রধানতম লেখক। প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতী (১৯৬৩)’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পান। বেশকিছু আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনাও লিখেছেন তিনি। একাত্তরের নয় মাস (১৯৯০) বইয়ে লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরূদ্ধকর দিনগুলোর কথা।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক, হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার, কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, শের-ই-বাংলা স্বর্ণপদক, ঋষিজ সাহিত্য পদক, লায়লা সামাদ পুরস্কার ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, নাট্যসভা পুরস্কার, শাপলা দোয়েল পুরস্কার, অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার, টেনাশিনাস পুরস্কার, বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ডসহ তিনি এ পর্যন্ত অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার ছোটগল্প ও উপন্যাসে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট (১৯৬৬), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্রুবতারা, মধুমতি (২০১০) ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী রাবেয়া খাতুনেরই লেখা।
সান নিউজ/এইজএস/আরআই/এস