নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “বাঙালি জাতি আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। আমরা এক সপ্তাহ আগে পদ্মা সেতুর মতো বড় কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করেছি। রুপপুর পরমানু কেন্দ্রের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ আবার পুর্ণ উদ্যোমে শুরু হয়েছে।”
১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।
এসময় ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকদের হাতে নিহত শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, নিজের তিনভাই- মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ জামাল এবং ১০ বছরের শেখ রাসেলসহ ওই রাতের সব শহীদের কথা স্মরণ করে তাদের শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজকের এই মহান দিনে আমি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী বিভিন্ন দেশ ও দেশের জনগণ, ব্যক্তি এবং সংগঠনের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বীর সদস্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভারতের তৎকালীন সরকার, রাজনৈতিক নেতা এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণকে- যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।”
ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মকদুম, খানজাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ষোল কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সকলের। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত, দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখনই পরাজিত শক্তির দোসররা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে শুধু একজন ব্যক্তি মুজিবের মহাপ্রয়াণ হয়নি। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল, তা স্তব্ধ করে দেয়া হয়। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে একটি আদর্শ ও স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটানো হয়। যে স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন এ দেশের লক্ষ-কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।”
তিনি বলেন, “জাতির পিতা শুধু একজন খাঁটি মুসলমানই ছিলেন না, তিনি ধর্মীয় আচারাদি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করতেন। তাঁর মতো আর কে বাংলার মানুষের মন-মনন-আকাঙ্ক্ষার বুঝতে পারতো! তাই তিনি যখন সংবিধান রচনা করেন, তখন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র - এই চারটি মৌলিক বিষয়কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জাতির পিতা ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং প্রসারে যা করেছেন, ইসলামের নামে মুখোশধারী সরকারগুলো তা কখনই করেনি। আইন করে মদ-জুয়া-ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপন, ওআইসি’র সদস্যপদ অর্জনের মত কাজগুলো বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে।”
৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “দুঃখের বিষয় ৭৫-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজেদের আসন চিরস্থায়ী করার পদক্ষেপ করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে।”
বিগত কয়েক টার্মে আওয়ামী লীগ সরকার আমলের কথা তুলে ধরে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার সরকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার এবং প্রসারে যত কাজ করেছে, অতীতে কোনো সরকারই তা করেনি। আমরা ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি। ৮০টি মডেল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং দাওয়ারে হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স মান দেওয়া হয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছি। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের সহায়তার জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় সারাদেশে মসজিদ-ভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষাধিক আলেম-ওলামায়ে কেরামের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এরপরও ১৯৭১’র পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানিং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।”
সান নিউজ/এস