নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ছিল তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ। পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী তাদের শোষণ-শাসন ধরে রাখতে, মুক্তিকামী বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখতে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, নারী-শিশু নির্যাতন চালিয়েছে।
অন্যদিকে, মুক্তিকামী বাংলার তরুণ, বৃদ্ধ, নারী এমন কী শিশুরাও তাদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে সবুজের বুকে লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে।
দিন যতই পার হতে থাকলো ততই পাকি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটতে থাকলো। এরপর শেষ যখন ডিসেম্বর শুরু হলো, তখনই পাকিসেনা, রাজাকার-আলবদরদের শেষঘণ্টা বাজতে শুরু করলো। প্রতিদিন করে বাড়তে থাকে মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশের মাটি। ৪ ডিসেম্বর তেমনই একটি দিন।
এদিন লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লার দেবীদ্বার, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, জামালপুরের ধানুয়াকামালপুর মুক্ত হয়। এ এলাকার মানুষেরা এদিন প্রথম মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশের বাতাস বুক ভরে টেনে নেন।
সেদিনের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনে সেই ভয়াবহ দিন আর মুক্তির বারতার কথা জানাচ্ছেন আমাদের জেলা প্রতিনিধি, সংবাদদাতারা।
দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি সানি সরকার জানান, ৪ ডিসেম্বর দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি পাক দখলদার বাহিনী ফুলবাড়ী থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়।
শত্রুমুক্ত করে ফুলবাড়ীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে যখন পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী উত্তাল আন্দোলন চলছিল, তখন ফুলবাড়ীতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে যাতে কোনো সংঘাত সৃষ্টি না হয়, সে জন্য মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফুলবাড়ীতে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ফুলবাড়ীতে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করে।
এরই মধ্যে ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় পাকি বাহিনী হানা দিয়ে হত্যা করে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে। পরদিন ২৬ মার্চ এ হত্যাযজ্ঞের সংবাদ ফুলবাড়ীতে এসে পৌঁছালে বাঙালিদের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ওই দিন সকালে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ফুলবাড়ী শহরে বের করা হয় এক প্রতিবাদ মিছিল। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে ফুলবাড়ী রেল স্টেশন থেকে কাঁটাবাড়ী বিহারী পট্টি হয়ে বাজারে ফেরার পথে বিহারী পট্টি থেকে মিছিলকে লক্ষ্য করে অবাঙালিরা গুলি ছুড়লে মুক্তিকামী মানুষ বিহারী পট্টির অবাঙালি ডা. শওকতের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ডা. শওকতসহ তার পরিবারের ৫ সদস্য ও অন্যান্য বিহারিরা পুড়ে মারা যান।
এর পর এপ্রিলের ২ তারিখ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ফুলবাড়ী আক্রমণ করে শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। শুরু হয় বাঙালিদের ওপর দখলদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার, হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা।
বছর ধরে এ হত্যাযজ্ঞ চলার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ফুলবাড়ীকে পাকি হানাদার বাহিনী মুক্ত করার জন্য ৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে ফুলবাড়ী থানার জলপাইতলী, পানিকাটা, দেশমা, রুদ্রানী, জলেশ্বরী, আমড়া, রানীনগরসহ বিভিন্ন সীমান্ত পথে ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করে এবং পাকি সেনাদের বিরুদ্ধে চতুর্মুখি আক্রমণ চালায়। এ সময় মিত্র বাহিনীর হাতে নিশ্চিত পরাজয় বুঝে পাকিসেনারা মিত্র বাহিনীর ফুলবাড়ী শহরে আগমন রোধ করতে ওই দিন বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৩টায় ফুলবাড়ীর ছোট যমুনার উপর লোহার ব্রিজটির পূর্বাংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। সেই ব্রিজটি কালের সাক্ষী হয়ে আজো বিরাজ করছে ফুলবাড়ীর যমুনা নদীর বুকে।
এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ফুলবাড়ী সরকারি কলেজের দক্ষিণ দিকে যমুনা নদীর উপরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার নিহত হন। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মেঠো পথে ফুলবাড়ী ছেড়ে সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ফুলবাড়ীকে পাকি দখলদার মুক্ত করে ফুলবাড়ীর পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয়। ফুলবাড়ীকে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর শুক্রবার শত্রুমুক্ত করে দেশমাতৃকার বীর সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফুলবাড়ী উপজেলার সিঅ্যান্ডবি ডাকবাংলায় স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
লক্ষ্মীপুর থেকে জেলা প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম স্বপন জানান, ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর পাকি হানাদার মুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা ও এ দেশিয় দোসর রাজাকার-আল বদরদের সহায়তায় লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ শেষে শত শত নিরীহ জনসাধারণকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ৯ মাসে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্নস্থানে মুক্তিবাহিনীর ১৭টি সম্মুখযুদ্ধসহ ২৯টি দুঃসাহসিক অভিযান চলে। এসব যুদ্ধে সৈয়দ আবদুল হালীম বাসু, মনছুর আহমদ, আবু ছায়েদ, আবুল খায়ের, নজরুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন, আতিক, মোস্তাফিজুর রহমান, আলী আহাম্মদসহ (ইপিআর) ৪০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এ দিন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হায়দার চৌধুরী এবং সুবেদার আবদুল মতিনের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হয়ে দালাল বাজার, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ হামছাদি, শাঁখারীপাড়ার মিঠানীয়া খাল পাড়সহ বাগবাড়ির রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে লক্ষ্মীপুরকে হানাদার মুক্ত করেন। প্রায় দেড় শতাধিক রাজাকারকে আটক করে এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করে। প্রকাশ্যে লক্ষ্মীপুর শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
এসব নারকীয় হত্যাযজ্ঞের আজও নিরব সাক্ষী হয়ে আছে শহরের বাগবাড়ির গণকবর, টর্চারসেল, মাদাম ব্রিজ বধ্যভূমি, পিয়ারাপুর ব্রিজ বাসুবাজার গণকবর, চন্দ্রগঞ্জ, মজুপুর, রসুলগঞ্জ ও আবদুল্যাপুর এবং রামগঞ্জ থানা সংলগ্ন বধ্যভূমি।
জেলার এক নারী মুক্তিযোদ্ধা হাজেরা বেগম মুক্তিসেনাদের ঘরে আশ্রয় ও রান্নার করে খাওয়ানোর জন্য উত্তর হামছাদী ইউনিয়নের বিজয়নগর গ্রামে তার দুটি বসতঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি হেদায়েতুল ইসলাম বাবু জানান, ৪ ডিসেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি হানাদার মুক্ত দিবস।
তাকে রুস্তম আলী কোম্পানির টু-আইসি গৌতম চন্দ্র মোদক বলেন, ‘একাত্তরের এইদিনে ফুলছড়ি এলাকা মুক্ত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১১নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার রুস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিশাল দল ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র বেষ্টিত গলনার চরে অবস্থান নেন।
তারা ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা আক্রমণে পাকিসেনাদের পরাস্ত করেন। এতে অনেক পাকিসেনা নিহত হয়।
৩ ডিসেম্বর সকালে আমার নেতৃত্বে (তখন আমি প্লাটুন কমান্ডার ছিলাম) গলনার চরে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা সামছুল ও সহযোগী কমান্ডার এনামুল হক, আব্দুল জলিল তোতা, নাজিম উদ্দিন, মহসিন আলী, তসলিম উদ্দিন ফুলছড়ির পাকসেনা শিবিরে আক্রমণ চালান।
দুঃসাহসী গেরিলা কমান্ডার সামছুল আলম ও অন্যান্য সহযোগী কমান্ডাররা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক অতর্কিতে ফুলছড়ি পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমনে পাকি হানাদার বাহিনী ফুলছড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়। থানা আক্রমনকারী গেরিলা কমান্ডার সামছুল আলম ও তার বাহিনী থানার অস্ত্রাগার থেকে ৪২টি রাইফেল, ২৫টি বন্ধুকসহ বিপুল পরিমাণ গোরাবারুদ নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন।
এই যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীদের হাতে শহীদ হন ৫ বীর মুক্তিযোদ্ধা। এরা হলেন- বগুড়ার জাহেদুল ইসলাম বাদল, সাঘাটার আফজাল হোসেন, আব্দুস সোবহান, ওসমান গণি ও কাবেজ আলী। পরদিন ৪ ডিসেম্বর সকালে ফুলছড়ি হানাদার মুক্ত হয়।
এই ৫ বীরের মরদেহ সাঘাটার মুক্তিনগর ইউনিয়নের খামার ধনারুহা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সমাহিত করা হয়।
জামালপুর জেলা প্রতিনিধি শোয়েব হোসেন জানান, ৪ ডিসেম্বর জামালপুর জেলার কামালপুর মুক্ত দিবস। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুর দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ১১নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সূচনা করেছিলেন ঢাকা বিজয়ের পথ।
কামালপুর রণাঙ্গন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনা, এ দেশিয় দোসর রাজাকার, আলবদররা বকশীগঞ্জ, কামালপুর ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হত্যা করে অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙালিকে।
এ সব হত্যাকাণ্ডের চিহ্ন হিসেবে অনেক গণকবর ছড়িয়ে রয়েছে কামালপুরসহ বকশীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা জুড়ে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিপরীতে জামালপুর জেলার পাহাড় ঘেরা বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল।
উত্তর রণাঙ্গনের ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল, যে কোনো মূল্যে এই ঘাঁটি দখল করতেই হবে। সে অনুযায়ী, সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের (বীর উত্তম) পরিকল্পনা অনুসরণ করে ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাকি হানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটি অবরোধ করেন।
ওই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আহসান মালিক খানের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনী ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ অন্যদিকে হানাদারদের ঘাঁটি রক্ষায় মরণপণ চেষ্টায় শুরু হয় প্রচণ্ড লড়াই।
এ অবরোধের প্রথম দিনের সম্মুখযুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের একটি পা হারান। ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান (বীর প্রতীক)।
৩১ বালুচের কমান্ডার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ জামালপুরের বারুয়ামারী ও শেরপুরের নকসী এলাকা থেকে আরও সৈন্য পাঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
২৯ নভেম্বর ৩১ বালুচের কমান্ডার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের নির্দেশে মেজর আইয়ুব কামালপুরের গ্যারিসন কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক খানের দূর্গে সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্য সরবরাহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
১০ দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় দূর্গে অবরুদ্ধ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক খানসহ ১শ ৬২ পাকিস্তানি সৈন্য মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। মুক্ত হয় কামালপুর। আর কামালপুর মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই সূচিত হয় শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ ঢাকা বিজয়ের পথ।
কামালপুরের এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন মমতাজ, মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান তসলিমসহ শহীদ হন ১শ ৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে, একজন ক্যাপ্টেনসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ২শ ২০ জন সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হন।
কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি কাজী এনামুল হক জানান, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল দেবীদ্বার।
৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিষ্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্ড ডিভিশনের মেজর জেনারেল আরডি বিহারের নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এই অভিযান পরিচালিত হয়। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং ব্রাক্ষণপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। খবর পেয়ে ওই রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা দেবীদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। এর পর মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ দেবীদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহরটি দেবীদ্বার থেকে চান্দিনা রোডে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার সময় মোহনপুর এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হলে মিত্রবাহিনীর ৬ সেনা সদস্য নিহত হয়।
তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্ট সন্নিকটে থাকায় এঅঞ্চলের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ৫ দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ৩১ মার্চ রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা এলাকায় নারকীয় এক হত্যাজজ্ঞ চালিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত ১৫ সদস্যের একটি পাকি সেনার দল পায়ে হেঁটে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি বর্তমান কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে যাত্রা শুরু করে।
৩১ মার্চ কাক ডাকা ভোরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের দেবীদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়িতে পৌঁছানোর পর এলাকাবাসী তাদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। পাকি সেনারা ধাওয়া খেয়ে দেবীদ্বার পৌর এলাকার চাপানগর গ্রামে ঢুকে এক গৃহবধূর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে আবুল কাসেম নামে এক যুবক ইট দিয়ে আঘাত করলে পাকি সেনাদের গুলিতে তিনি প্রথম শহীদ হন।
শত্রুসেনারা বারেরা কোড়েরপাড় পৌঁছানোর পর হালচাষরত কৃষক সৈয়দ আলী শত্রু সেনাদের দেখে হাতের পাজুন দিয়ে পাকি সেনাদের পেটাতে থাকেন। এ সময় পাকিসেনাদের গুলিতে সহকর্মী মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে আব্দুল মজিদ ঝাঁটা নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করে হায়ানাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।
মৌলভীবাজার থেকে জেলা প্রতিনিধি ফেরদৌস আহমেদ জানান, ৪ ডিসেম্বর কমলগঞ্জ মুক্ত দিবস। এইদিনে কমলগঞ্জের ভানুগাছ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে সদর থেকে পাকিবাহিনী পিছু হটে এবং স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানো হয়।
ভানুগাছ বাজারের কাছে ধলাই সেতুতে সম্মুখযুদ্ধে ৩ জন ও কমলগঞ্জ থানার সামনে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর সময় অপর একজন অস্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য পাকি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।
শহীদরা হলেন- কুমিল্লার মুরাদনগরের কালাপাইনা গ্রামের সিপাহী মো. মিজানুর রহমান, দেবীদ্বারের বড় শালঘর গ্রামের সিপাহী আব্দুর রশিদ, পাবনা শাহাদাৎপুরের দারগাপাড়া গ্রামের ল্যান্স নায়েক জিল্লুর রহমান, চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের মগাদিয়া গ্রামের সিপাহী মো. শাহাজান মিয়া।
সম্মুখযুদ্ধে নিজের জীবন উৎসর্গকারী এই ৪ বীর যোদ্ধাকে ৫ ডিসেম্বর সকালে পাশের আলীনগর ইউনিয়নের পশ্চিম কামুদপুরে দাফন করা হয়। সেই থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর কমলগঞ্জ মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
সান নিউজ/এসএম