নিজস্ব প্রতিবেদক:
উন্নত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত এবং আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত সাবওয়ে বা পাতাল রেল। বাংলাদেশে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পর এবার পরিবহন ব্যবস্থায় আরও গতি আনতে সেই পাতালে রেলের দিকেই দ্রুত ছুটছে সরকার, চলছে সমীক্ষা।
২৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাতাল রেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দিনে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটবে মাটির নিচ দিয়ে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২০-২৫ মিটার নিচ দিয়ে চলবে যাত্রীবাহী ট্রেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলের পরই জোর দিচ্ছে এই সাবওয়ে প্রকল্পে।
রাজধানীতে মেট্রোরেলকে আরও বিস্তৃত করতে ৫১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মিত হবে। আর এর বড় অংশই হবে পাতাল রেল। এজন্য মেট্রোরেল লাইন-১ ও ৫ নামে দুটি প্রকল্পে ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
সড়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোরেল লাইন-১ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে। বাকিটুকু হবে এলিভেটেড বা মাটির ওপর দিয়ে হবে। অন্যদিকে মেট্রোরেল লাইন-৫-এর আওতায় সাভারের হেমায়েতপুর থেকে সেনানিবাস হয়ে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার হবে পাতাল রেল। বাকি ছয় কিলোমিটার থাকবে এলিভেটেড বা উড়ালপথ।
পাতাল রেল করা হবে জাপানের ওসাকা সিটির আদলে। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল চারটি রুটে এই পাতাল রেল নির্মানের। পরে তা বহুমুখী রুটে নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। টঙ্গি থেকে সদরঘাট ২৬ দশমিক ২৯ কিলোমিটার, গাবতলী থেকে পূর্বাচল ১৭ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার, বছিলা থেকে কায়েতপুর ১৬ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার হাজারিবাগ থেকে রাজারবাগ ১৩ কিলোমিটার, কামরাঙ্গিচর থেকে নিউমার্কেট ১৩ কিলোমিটার, বছিলা থেকে মালিবাগ ১৪ কিলোমিটার, গাবতলী থেকে শ্মশানঘাট ১৪ কিলোমিটার, গাবতলী থেকে পূর্বাচল এবং টঙ্গি থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকার তলদেশ ও ভূমির বৈশিষ্ট্য পাতাল রেল নির্মাণের উপযোগী, যা জাপানের ওসাকা শহরের অনুরূপ। তাই ওসাকার মতোই রাজধানীতে মাটির ২০ থেকে ২৫ মিটার গভীরে পাতাল রেল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাছিমা বেগম জানান, আগের পরিকল্পনায় মোট ৯০ কিলোমিটার সাবওয়ে নির্মাণের কথা ছিল। এখন তা ১৪৮ কিলোমিটার বাড়িয়ে ২৩৮ কিলোমিটার করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, সমীক্ষা এবং প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের জন্য ২০১৮ সালের অগাস্টে টেকনিকা ওয়াই প্রয়েক্টসের সঙ্গে ২১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল। সেই খরচ এখন ৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ৩১৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা করা হয়েছে বলে জানান নাছিমা।
২০২০ সালের এপ্রিলে সমীক্ষার কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় পাতাল রেলের অবস্থান, এলাইনমেন্ট ও দৈর্ঘ্য নির্ধারণ, জিওটেকনিক্যাল ইনভেস্টিগেশন ও ট্রাফিক সার্ভে পরিচালনার নকশা পরিবর্তনও করা হয়েছে। প্রাথমিক নকশা, ভূমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা ও আর্থিক বিশ্লেষণ করা হবে। এর পরেই বিশাল ব্যয়ের মেগা প্রকল্পটি গ্রহণ করবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, যা বাস্তবায়ন করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
পাতাল রেল প্রকল্পের পরিচালক সেতু বিভাগের প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস বলেন, ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লক্ষ। শহরে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৭ হাজার ৯৫০ জন। কিন্তু এতো বিপুল পরিমাণ মানুষের জন্য সড়ক আছে মাত্র ২৮৬ কিলোমিটার।
হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় সড়কের ঘনত্ব ৯ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু এর আদর্শমান হচ্ছে ২০-২৫ শতাংশ। সড়কপথে প্রতি ১০০ বাসে ঘণ্টায় যাতায়ত করে মাত্র ১০ হাজার যাত্রী। এ সঙ্কট সমাধানে মেট্রোরেলের পাশাপাশি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারে পাতাল রেল। তিনি বলেন, এতে ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দীন সরকারের নতুন এই প্রকল্প প্রসঙ্গে সান নিউজকে বলেন, পাতাল রেল করতে অনেক সময় ও অর্থ প্রয়োজন। এটা অনেকটা টিউব রেলের মতো। কিছু দূর পর পর স্টেশন থাকবে। এর ভেতরে ‘লাইট ট্রেন’গুলো চলবে। ভেতরের গতি থাকবে অনেক বেশি। যেমন— ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথ পেরোতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট।
পৃথিবীর অনেক দেশে নদীর নিচেও রেলপথ আছে। বিখ্যাত ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে লন্ডন-প্যারিস রেলপথের কথা অনেকেরই জানা। সুইজারল্যান্ডে আল্পস পর্বতের নিচে ৫৩.৮ কিলোমিটারের রেলপথ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেলসুড়ঙ্গ। প্রতিদিন এই টানেল দিয়ে ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ২৫০টি ট্রেন চলে। নদীর নিচে রেল কলকাতায়ও হচ্ছে। চালুর অপেক্ষায় থাকা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর একটা অংশ গঙ্গার নিচ দিয়ে গেছে, যা কলকাতা ও হাওড়াকে যুক্ত করেছে।
পৃথিবীর প্রথম পাতাল রেল চালু হয় লন্ডনে। সেটা ১৮৬৩ সালে। তার ৩০ বছর পর শহরটিতে চালু হয় বিদ্যুতচালিত পাতাল রেল। এই রেলপথ লন্ডন, এসেক্স আর হার্ডফোর্ডশায়ারে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত মেট্রো রেলপথ বেইজিং সাবওয়ে। এ ছাড়া ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরেই পাতাল রেল রয়েছে, যা অসম্ভব জনপ্রিয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষও অন্তর্ভূক্ত হতে যাচ্ছে হচ্ছেন সেইসব সৌভাগ্যবানেদের তালিকায়।