নিজস্ব প্রতিবেদক:
সারাবিশ্বে এখন আতঙ্ক একটাই। করোনাভাইরাস। চীন ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের উৎসস্থল হলেও গত দুই মাসে তা সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৮৫টি দেশ। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যূ হয়েছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের। প্রতিবেশী ভারতে ক্রমশই বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা যে ২৫টি দেশের নাম উল্লেখ করেছে, সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে তা মোকাবেলায় কতোখানি প্রস্তুত এদেশ? মুখে মুখে এখন সেই প্রশ্ন। দেশের হাসপাতালগুলোর আইসোলেশন ওয়ার্ড, ঢাকার বাইরের রোগীদের জন্য করণীয় ব্যবস্থা, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের স্ক্রিনিং সক্ষমতাসহ অনেক বিষয় নিয়ে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। এই উদ্বেগ থেকেই বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট করোনা প্রতিরোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানতে চেয়েছে সরকারের কাছে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা ও বিভাগীয় শহরের বড় বড় শপিং মল, বিপণিবিতান, আবাসিক হোটেল, জনার্কীর্ণ স্থানগুলোতে এখনও সতর্কতামূলক তেমন কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চিকিৎসার যতটুকু পূর্ব প্রস্তুতি, তাও রাখা হয়েছে কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক। যদিও প্রাণঘাতী এই ভাইরাস মোকাবিলায় সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নিয়েছে। তারপরও কোভিড-১৯’এর মতো আগ্রাসী করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সেই প্রস্তুতি কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকেও যেভাবেই হোক করোনা প্রতিরোধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন করছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এই ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, “জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিন স্তরে আন্তঃমন্ত্রণালয়, সমন্বয় ও টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া করোনার উপসর্গ রয়েছে এমন রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সারাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ওই পর্যায়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীর কীভাবে চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা দেয়া হবে সে বিষয়ে নির্দেশান দেয়া হয়েছে।” তিনি আরও জানিয়েছেন যে, কয়েকদিন পরই র্যাপিড টেস্টের সব ধরনের ফ্যাসিলিটিজ দেশে চলে আসবে। তখন ২৪ ঘণ্টাতেই নমুনা পরীক্ষার ফল জানা যাবে। ওষুধ, কিট, মাস্ক, গাউনেরও কোনো সঙ্কট নেই বলে দাবি আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষের।
আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেছেন, “অনেক আগে থেকেই করোনাভাইরাসের পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি আমরা। যে প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কাজ করছি এবং যদি রোগী পাওয়া যায় তখন কী করা হবে, সেসব প্রস্তুতির খসড়া আমরা তৈরি করেছি। সেটা চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।”
বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১০ হাজার শয্যার ব্যবস্থা করাসহ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে করোনা ভাইরাসের প্রস্তুতি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও এ ভাইরাস আক্রান্ত হলে আধুনিক এবং বড় হাসপাতাল ছাড়া বাংলাদেশের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, শুধু হাসপাতালে শয্যা রাখলেই হবে না। জেলা উপজেলায় এর চিকিৎসা কতটা আছে, সেটিই মূল বিষয়। তিনি বলেন, "বাস্তব অবস্থায় বড় বড় হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও এর চিকিৎসা করা সম্ভব না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মুল প্রভাবটা পড়ে ফুসফুসে। তখন শ্বাসকষ্ট হয়, অক্সিজেন নিতে পারে না। এ অবস্থায় প্রয়োজন পড়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নিরুপণের যন্ত্র।” এ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন, "ভেন্টিলেটার এবং মনিটর থাকতে হবে। সার্বক্ষণিক নার্স ডাক্তার থাকতে হবে। এমন ব্যবস্থা আমাদের কয়টা হাসপাতালে আছে?"
এদিকে বাংলাদেশে ভাইরাস স্ক্রিনিং-এর জন্য কর্মক্ষম থার্মাল স্ক্যানার আছে মাত্র একটি৷ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া আর কোথাই স্ক্যানার নেই। বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ জানান, “আমাদের থার্মাল স্ক্যানার ছিল মোট তিনটি, এর মধ্যে দুটিই নষ্ট ।” শাহজালাল ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো বিমানবন্দর বা স্থলবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারতো দূরের কথা, স্ক্যানার বলতেই কিছু নেই৷ বিষয়টি এরই মধ্যে নজরে এনেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এই মুহুর্তে বাংলাদেশের সব বিমান বন্দরে থার্মাল স্ক্যানার বসানো জরুরি। উল্লেখ্য, থার্মাল স্ক্যানারের মধ্য দিয়ে কোনো যাত্রী পার হলে সহজেই তার শরীরের তাপমাত্রা বোঝা যায়৷ যদি সবুজ আলো জ্বলে তাহলে স্বাভাবিক৷ লাল আলো জ্বললে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক৷ স্থল বন্দরগুলোর মধ্যে লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দরে কোনো ধরনের স্ক্যানিং সিস্টেম ছিলনা৷ কয়েকদিন আগে দুটি থার্মাল মিটার (থার্মোমিটার) দেয়া হয়েছে৷ এই দুটি দিয়ে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে৷
মেডিসিনের প্রবীণ অধ্যাপক এম এ ফয়েজ জানিয়েছেন, ভাইরাস অধ্যয়ন, নির্ণয় এবং চিকিৎসায় বাংলাদেশের সামর্থ্য অনেক কম। দেশে শতাধিক মেডিকেল কলেজ ও অনেকগুলো গবেষণাগার থাকলেও নির্দিষ্টভাবে ভাইরাস শাস্ত্রচর্চা হয় না কোথাও, নেই কোথাও কোন পূর্ণাঙ্গ ল্যাবও।
তবে আরেক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সান নিউজকে বলেন, “যেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে তাতে আশা করা যায়, আমরা করোনা মোকাবিলা করতে পারব।
তবে ভারতে যেহেতু করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তাই আমাদের আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে।”
সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কেউ আক্রান্ত হলে তাদের স্যাম্পল সংগ্রহ করে ঢাকায় আইইডিসিআর’এ পাঠানো হবে। কিন্তু আক্রান্ত কতো মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা একমাত্র এই আইইডিসিআর-এর পক্ষে করা সম্ভব, সেই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিতে পারেননি কেউ।