নিজস্ব প্রতিবেদক:
পিরোজপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও তার স্ত্রীর জামিন নামঞ্জুরকারী বিচারকের তাৎক্ষণিক বদলি এবং কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভারপ্রাপ্ত জজের আদালতে জামিন মঞ্জুরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাদের মতে, বাংলাদেশের অধস্তন আদালতের বিচারিক ইতিহাসে এই ঘটনা বিরল ও ভয়াবহ এক দৃষ্টান্ত’। একই সঙ্গে দেশে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থাটি।
বুধবার (০৪ মার্চ) সন্ধ্যায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘দুদকের মামলায় জেলা ও দায়রা জজের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তার স্ত্রীর জামিন নামঞ্জুরকে কেন্দ্র করে, তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিচারককে ওএসডি ও বদলি করে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা এবং কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভারপ্রাপ্ত জজের মাধ্যমে জামিন মঞ্জুরের ঘটনা অভূতপূর্ব। যা দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।’
বিবৃতিতে আরও ্লা হয় যে, ‘এই ঘটনা আদালতের ওপর নির্বাহী বিভাগ ও রাজনৈতিক প্রভাবের ব্যাপক বিস্তার, প্রভাবশালীদের হাতে আইনের শাসনের জিম্মি হওয়া ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে ক্রমাগত বিকাশে তৎপর স্বার্থান্বেষী মহলকে আরো ক্ষমতায়িত করবে।’
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (৩ মার্চ) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে দুদকের দায়ের করা এক মামলার আসামী পিরোজপুর জেলা জজ আদালতে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম.এ. আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীন জামিনের আবেদন করেন। বিচারক আবদুল মান্নান জামিন নামঞ্জুর করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এই ঘটনার মাত্র চার ঘণ্টা পর বিকাল পৌনে চারটার দিকে পিরোজপুরের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক নাহিদ নাসরিনের আদালতে জামিন বাতিলের আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন জানান আসামী পক্ষ। বিচারক আউয়াল দম্পতির জামিন মঞ্জুর করেন। এরপরই জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবদুল মান্নানকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সাথে তাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয় এবং তার দায়িত্ব অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ নাহিদ নাছরিনকে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়।
কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এ খবর প্রকাশিত হলে তা আদালতের নজরে আসে। আবদুল মান্নানকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে বুধবার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আগামী ১১ মার্চের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এ রুলের জবাব দিতে বলেছেন আদালত। বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ রুল জারি করেন।
অপরদিকে ওই বিচারককে প্রত্যাহারের কারণ জানিয়ে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, রূঢ় ও অশালীন আচরণ করায় তাকে প্রত্যাহার (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়েছে।
এসময় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আবদুল মান্নান অত্যন্ত রূঢ় ও অশালীন আচরণ করেছেন। তাই তাকে প্রত্যাহার (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়েছে। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল এবং তার স্ত্রী লায়লা পারভীনকে জামিন দেওয়া হয়েছে।’
আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই ঘটনায় বারের সকলে আদালত বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন। এই পরিস্থিতিতে গন্ডগোল চলছিল। রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে পড়েছিল। সেটাকে কন্ট্রোল করার জন্য বিচারককে স্ট্যান্ড রিলিজ করে আদেশ দেওয়া হয় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে। জামিন দেওয়া না দেওয়া সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। কিন্তু আদালত যদি এমন ব্যবহার করে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইনের শাসন রক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। সেই অবস্থার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তার স্ত্রীকে জামিন দেওয়া হয়। আমি মনে করি এখানে আইনের শাসনের কোনও ব্যত্যয় হয়নি।’ যদিও এর আগে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার জামিন পাওয়ার পর পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আমাদের বিরুদ্ধে যে তিনটি মামলা করেছে, তা মিথ্যা। এ মামলায় হাইকোর্টে আট সপ্তাহের জামিন পেয়েছি। এরপর শ ম রেজাউল করিম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করে এবং শুনানিতে জামিন নাকচ হয়ে যায়।’
তবে বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, তার সম্পর্কেএ কে এম এ আউয়ালের সব অভিযোগ মিথ্যা।
শ ম রেজাউল করিম জানান, ‘মন্ত্রী হওয়ার পরে কোনও নিয়োগবাণিজ্য, কমিশনবাণিজ্য করি নাই, করবোও না ইনশাআল্লাহ। আমি আইন পেশায় নতুন নই। এ পেশা থেকে স্বচ্ছতার সঙ্গে আয় করেছি। সে আয় থেকে জমি কিনেছি। গাড়ি নেওয়ার যে কথা তিনি (এ কে এম এ আউয়াল) বলেছেন তাও মিথ্যা অভিযোগ। তিনি আরও যেসব অভিযোগ করেছেন তাও ভিত্তিহীন।’
উল্লেখ্য, দুর্নীতির অভিযোগে পিরোজপুর-১ (পিরোজপুর-নাজিরপুর-নেছারাবাদ উপজেলা) আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আউয়াল ও তার স্ত্রী পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লায়লা পারভীনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আলী আকবর বাদী হয়ে বরিশাল দুদক কার্যালয়ে তিনটি মামলা করেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, মামলাগুলোর মধ্যে একটিতে আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লাকে আসামি করা হয়েছে। বাকি দুটিতে এককভাবে আসামি করা হয়েছে আউয়ালকে। মামলা দায়েরের পর তারা গত ৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানালে তাদের আট সপ্তাহের আগাম জামিন দেয়া হয়। সেই মেয়াদ শেষ হওয়ায় মঙ্গলবার (৩ মার্চ) পিরোজপুরের জেলা জজ আদালত থেকে তারা ফের জামিন পান বিতর্কিতভাবে।