নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীতে প্রতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারের মধ্যে নেমে এসেছে গণপরিবহন চলার গতি। যার কারনে রাজধানীতে কর্মমুখর মানুষের দৈনিক নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা, আর রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা, অপচয় হচ্ছে মূল্যবান জ্বালানি। এ বিষয়ে ফ্রাঞ্চাইজি গঠন নিয়ে বৈঠক ১০ নভেম্বর।
৫ নভেম্বর দুপুর বেলায় রাজধানীর নর্দা এলাকায় প্রধান সড়কে এলোমেলোভাবে দাঁড় করিয়ে যাত্রী খুঁজছে দুটি তুরাগ পরিবহণ, একটি আকাশ ও একটি ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাস। পুরোপুরি প্রধান সড়কটি আটকে থাকায় পেছন থেকে হর্ন দিয়ে বাতাস ভারি করে তুলছে আরও ৬-৭টি বাস, ১৫-২০টি প্রাইভেটকার, ১০-১২টি মোটরসাইকেল ও বেশ কয়েকটি অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন। সড়কে জমে যায় শতাধিক গাড়ি। বিপদে পড়ে যানজটে আটকা পড়ে শত শত মানুষ।
কিছুটা ফাঁক খুজে পেছনে আটকা পড়া অনাবিল পরিবহনের একটি বাস ডান লেন দিয়ে টান দিয়ে সামনে গিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর ফের চলতে শুরু করে। নতুন বাজারে গিয়ে আবার রাস্তা আটকে দাঁড়ায় বাসগুলো। দীর্ঘদিন যাবত এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা আটকে রাখার পর ঠোকাঠুকি করতে করতে চলতে শুরু করে বাসগুলো। রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত অন্তত ১১টি স্থানে যাত্রী তোলার জন্য রাস্তার সব লেন আটকে যানজট সৃষ্টি করে বাসগুলো।
সরেজমিনে, বাস সার্ভিসগুলোর এমন দৃশ্য দেখতে রামপুরা পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, ১১টি স্থানে বাসটি রাস্তার বিভিন্ন লেনে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করে। নিজেদের ইচ্ছে মাফিক রাস্তা আটকে যাত্রী ডাকতে থাকেন বাসের হেলপার-কন্ডাক্টর। নতুন বাজার এলাকায়ও একইভাবে রাস্তা আটকে যাত্রী তুলতে দেখা যায় অছিম, অনাবিল, ভিক্টর ক্লাসিক, রাইদা, আকাশ, রইস পরিবহনের কয়েকটি বাসকে।
এরই মধ্যে কোথাও যাত্রী দেখলে অন্য বাসের গতিরোধ করতে হঠাৎ ডান লেন থেকে দ্রুত গতিতে বাম লেনে, আবার অন্য বাসের পথ আটকাতে বাম লেন থেকে দ্রুত ডান লেনে চলে যেতে দেখা যায় বাসগুলোকে। নর্দা থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে ৪৮ মিনিট। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে “দ্য ফিউচার প্লানিং অব আর্বান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা” শীর্ষক এক সেমিনারে উত্থাপিত গবেষণাপত্রে বলা হয়, ঢাকায় যানবাহনের গতি হাঁটার গতির মতো ঘণ্টায় প্রায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।
রাজধানীতে যানবাহনের দৌরাত্ম আর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বাসের এ নৈরাজ্য বন্ধ করে যানজট ও দুর্ঘটনা কমাতে বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজি গঠনে জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, এতে বাস ড্রাইভারদের বাড়তি আয়ের জন্য রেষারেষি করতে হবে না। মাস শেষে তাদের নির্ধারিত বেতন নিশ্চিত থাকবে।
এ ব্যাপারে উত্তর সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক উদ্যোগ নিলেও তার মৃত্যুর পর তা থেমে যায়। দুই সিটির মেয়র নতুন করে কাজটি শুরু করেছেন। এ নিয়ে গত ৬ অক্টোবর নগর ভবনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির এক সভা হয়। সভায় দুই সিটির মেয়র, ট্রাফিক বিভাগ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাস মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে দক্ষিণের মেয়র তাপস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন ও টার্মিনাল নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিবেদন হাতে পেলে আগামী সভা থেকে কাজ শুরু হবে।আগামী ১০ নভেম্বর সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে সড়কে ৮০ ভাগ যানজটের জন্য বাসের চালকদের অদক্ষতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করেন যাত্রী সাধারণ। বাস ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন এভাবে রাস্তা আটকে যাত্রী তোলে না। মূল সড়কে রিকশার কারণেও যানজট হয়। জলিল নামের এক সিএনজি চালক বলেন, করোনার কারণে বাস বন্ধ থাকার সময় দিনে ২৫০-৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সিএনজি চালিয়েছি। বাস চালু হওয়ার পর সারাদিনে ১০০ কিলোমিটারও চালাতে পারিনা। বাসের কারনে যানজটে আটকা থেকে গ্যাস পোড়াতে হয়।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার (ঢাকা দক্ষিণ) বাসুদেব বণিক বলেন, আমরা মামলা দিচ্ছি। জরিমানা করছি। বিআরটিএ মোবাইল কোর্ট বসাচ্ছে।তার পরও বাস সার্ভিসগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সব জায়গায় তো পুলিশ চেকপোস্ট নেই। চালকরা পুলিশ দেখলে ঠিকভাবে চালায়, সামনে গিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে।
দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় ১০ সদস্যের কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটি ১১টি মিটিংও করে। আমাদের প্রস্তাব ছিল দ্রুত চারটি ডিপো নির্মাণ, সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে গাড়ি দেওয়া, পুরনো গাড়ি সরকারের পক্ষ থেকে কিনে নেওয়া ও কোম্পানি গঠন। আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। করোনায় সব থেমে যায়। বর্তমানে দুই সিটির মেয়র আবার উদ্যোগ নিয়েছেন। গত মাসে এ নিয়ে একটা সভা হয়েছে।
আগামী ১০ নভেম্বর ফের সভা আছে। আশা করছি একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারব। বাস মালিকরা রেশনালাইজেশনে রাজি। সরকারের কাজগুলো যত দ্রুত হবে তত দ্রুত নগরবাসী একটা ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা পাবে।
সান নিউজ/এসএ