নিজস্ব প্রতিবেদক:
অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেশে-বিদেশে যেমন প্রশংসা কুড়াচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন প্রকল্পে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হওয়ায় তা নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মাঝে। দেশের বড় প্রল্পগুলোর ব্যয় পাশ্ববর্তী দেশ ভারত-শ্রীলঙ্কা কিংবা চীনের ব্যয়ের কয়েকগুন বেশি। এ ধরণের প্রকল্পগুলোতে এই অস্বাভাবিক ব্যয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিতে বাঁধার সৃষ্টি করছে বলে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
তারা বলছে, প্রকল্প ব্যয় অতিমাত্রায় হয়ে যাওয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের শতভাগ সুফল যোগ হচ্ছে না দেশের অর্থনীতিতে। বিশেষ করে সড়ক পথ, রেলপথ এবং ফ্লাইওভার নির্মান ব্যয় হকচকিয়ে দিয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
এই বাড়তি খরচের জন্য উচ্চ মাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়া ও দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক।
দুই বছর আগে বিশ্বব্যাংক তার এক প্রতিবেদনে জানায়, চার লেন সড়ক নির্মাণের মধ্যে রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কে সড়কের প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৬৬ লাখ ডলার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৭০ লাখ ডলার, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার খরচ নির্ধারিত হয়েছে।
অন্যদিকে চার লেন সড়ক তৈরিতে ভারতে ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার ও চীনে ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ ডলার খরচ হয়।
এই হিসাব অনুযায়ী ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার খরচ ভারতের কিছু সড়কের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।
বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি। অভিযোগ রয়েছে, ফ্লাইওভার নির্মাণে একেবারেই অনভিজ্ঞ সরকারি সংস্থাগুলো সম্ভাব্যতা যাচাই করিয়ে নেয় যেনতেনভাবে। আগে থেকে পরিকল্পনা না নিয়ে হঠাৎ করে রাজনৈতিক চাপেও প্রকল্প নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ভুল নকশায় কাজ শুরু করে পরে নকশা প্রণেতাকেই খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কাজ শুরুর পর প্রকল্পের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েও ব্যয় বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত এসব ফ্লাইওভারে যে খরচ দাঁড়ায় তা এশিয়ার যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
গত বছরের শেষের দিকে উদ্বোধন হওয়া কোলকাতার ৮.১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পরমা ফ্লাইওভার নির্মানে ব্যয় হয়েছে ৩৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
সম্প্রতি চীনে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে ৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অথচ বাংলাদেশে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘের মগবাজার-মৌচাক সমন্বিত ফ্লাইওভার নির্মানে খরচ পড়েছে ১৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত।
বিশ্বমানের রেলপথ নির্মানে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ৩১ কোটি টাকা। আর দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক সিঙ্গেল ট্র্যাকের লাইন, সিগন্যালিং ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ কিলোমিটার প্রতি রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ২৩ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ কোটি টাকা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রেলপথ নিয়ে শতাধিক প্রকল্প রয়েছে। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়বে ১২ থেকে ১৭ কোটি টাকা। আর চীনে সিঙ্গেল লাইনের সাধারণ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। পাকিস্তানে রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি গড় ব্যয় হয় ১৫ কোটি টাকা।
রেলপথ নির্মাণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের খরচ অস্বাভাবিক বেশি। ভারতে এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে যেখানে ৫-৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়, সেখানে আমাদের দেশে ‘আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশনের মিটার গেজ রেললাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর’ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৭১ কোটি টাকা।
আখাউড়া-সিলেট রেলপথ ডুয়েলগেজ রূপান্তর প্রকল্পের আওতায় ২৩৯ দশমিক ১৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে। এর মধ্যে ১৭৬ দশমিক ২৪ কিলোমিটার মূল রেলপথ ও ৬২ দশমিক ৯০ কিলোমিটার লুপ লাইন রয়েছে। জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। দরপত্র ছাড়াই দরকষাকষির মাধ্যমে এ ঠিকাদার চূড়ান্ত করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, জমি অধিগ্রহনে অ-স্বচ্ছতা, দলীয় প্রভাব এবং দরপত্র প্রক্রিয়াতে দুর্নীতির কারণেই বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে।