নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের সিনিয়র সাংবাদিক রাশেদ চৌধুরী। রান্নাবান্নার প্রতি তাঁর রয়েছে এক ধরণের বিশেষ আকর্ষণ। প্রতি শুক্রবার পরিবারের সবার জন্য দেশ-বিদেশের বিশেষ খাবার নিজ হাতে রান্না করেন তিনি। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি ছিলো শুক্রবার। হয়তো কিছু না ভেবেই ওইদিন তিনি বিলেতি একটা খাবার রান্না করে তার ছবি দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। আর সেটি নিয়ই শুরু হয়ে গেল এক ধরণের বিপত্তি। নানা প্রতিক্রিয়া বন্ধুমহলের। একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে বিদেশি খারার? এমন প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হতে থাকে রাশেদ চৌধুরীকে। মজার বিষয় হচ্ছে, ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার দিনটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিদেশি খাবারের যারা সমালোচনা করছিলেন তারাই তাদের অধিকাংশ মন্তব্য লিখেছেন ইংরেজি রোমান হরফে। অথচ খাবারের জন্য নয়, প্রিয় বাংলার জন্য লড়াই করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। এ কথাটাই যেন বেমালুম ভুলে গেছেন তারা।
মুঠোফোনের খুদে বার্তায় প্রায়ই বাংলা লিখতে আমরা ইংরেজি রোমান হরফ ব্যবহার করি। নানামুখী সমালোচনার পরও তা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বিটিআরসি’র তরফ থেকে গ্রাহকদেরকে ইংরেজি হরফে বাংলা বার্তা পাঠানো থেকে বিরত থাকার জন্য মোবাইল ফোন অপারেটরদের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা এখনও চলছে। শুধু তাই নয়, ইংরেজি শব্দকে বাংলা হরফের বানানে লিখে প্রতিষ্ঠানের ব্যানার, নামফলক তৈরি করা হচ্ছে এখনও। এমন চিত্র দেশের সব জায়গাতেই সরকারি কিংবা বেসরকারি ক্ষেত্রে কম-বেশি দেখা যায়।
আর বাংলার আলো-বাতাসে বেড়ে উঠলেও ইংরেজি উচ্চারণে অনেকের বাংলা বলার ধরণটা যেন আধুনিকতার প্রকাশ! এ ধরণের বাঙালির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে থেকে যাঁরা বাংলা ভাষার মতো করে বাংলা বলতে পারেন না, ইংরেজি উচ্চারণে কথা বলেন, তাঁদের প্রতি করুণা করা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই’।
এই বাংলা ভাষাকেই আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন ভাষা বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ বাংলার তৎকালীন পণ্ডিতরা।
১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে মন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহার বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। বাংলাকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ষড়যন্ত্র শুরু তখন থেকেই। এরপর ১০ জুন করাচীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় মাধ্যমিক স্তর থেকে উর্দুকে গোটা পাকিস্তানের শিক্ষায় বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যদিও হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য সেটিকে করা হয় ঐচ্ছিক। পূর্ববঙ্গের শিক্ষা বিভাগের পরিচালক ড. কুদরত-ই-খুদা প্রস্তাব করেন রোমান বর্ণমালা গ্রহণের । (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ জুন ১৯৪৮)।
১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল হালিমের সভাপতিত্বে এক সভায় ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারের এ ধরণের হীন প্রচেষ্টার প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় বর্ণমালা সংগ্রাম পরিষদ। (দৈনিক আজাদ, ১৪ ডিসেম্বর; সাপ্তাহিক সৈনিক ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৯)।
আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফজলুর রহমান নামে একজন বাঙালী। বেক্সিমকো গ্রুপের সালমান-সোহেল রহমানদের বাবা ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি অল-পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনে এই প্রস্তাব পেশ করেন। এর পরপরই ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮ পূর্ববঙ্গ লেখক সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্পষ্টভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিকে তুলে ধরলেন জোরদারভাবে। (ডেইলি স্টার ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১)
তিনি যুক্তি উপস্থাপন করে দাবি করেন, বাংলা ভাষা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মানের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। তাও আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে। তার পর থেকে বাংলা ভাষা পাড়ি দিয়েছে বহু যুগ, বহু পথ। মায়েরা ভাষা বাংলার জন্য রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। প্রাণ হারিয়েছে ছাত্র-জনতা।
এতদিন এবং এতোকিছুর পরও আমরা প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে রোমান হরফে লিখে চলেছি রক্তে ভেজা বাংলাকে, যা আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তীব্র ঘৃণায়।
শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয় রাষ্ট্রীয়ভাবেও রোমান হরফে প্রকাশ চলছে বাংলা ভাষার। প্রতিনিয়তই আমাদের মুঠোফুনে রাষ্ট্রীয় অনেক ক্ষুদে বার্তা আসে, যা রোমান হরফে লেখা।
শুধু রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা সাধারণ মানুষ নয়, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কৃষকের কাছে মুঠোফোনে যে সব বার্তা পাঠানো হয়, তাও ওই রোমান হরফে। সামান্য এ কথাটা কেউ ভাববার অবকাশ পান না যে, দেশের কৃষকদের অধিকাংশই এখনও রোমান হরফ তো দূরের কথা বাংলা হরফও ভালো করে চেনেন না।
বাংলা ভাষা প্রকাশের জন্য ৭০ বছর আগের ষড়যন্ত্রের নাম রোমান হরফকে বাংলা হরফের স্থলাভিষিক্ত করা। সেই ষড়যন্ত্রের কাজটি আমরা নিজেরাই করে চলেছি আমাদের অজ্ঞাতসারে । বিষয়টি নিঃসন্দেহে খুবই নাজুক ও বাংলা ভাষার জন্য ভয়াবহ। নীতিনির্ধারক বা পণ্ডিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ এ বিষয়ে বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি কথা বললেও তাদের অনেকেও থাকেন উদাসীন। প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে মুঠোফোনে রোমান হরফে খুদে বার্তা পাঠানোর কোনো যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না। কারণ এখন বাংলা লিখতে অনেক উন্নত সফটওয়্যার বেরিয়ে গেছে। বাংলা বর্ণমালাতে লিখেই এখন ডোমেইন কেনা যাচ্ছে। গুগলে বাংলায় অনুসন্ধান করা যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ডিজিটাল সময়ের দোহাই দিয়ে আমরা বাংলা হরফকে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও থেকে বিদায় করে দিচ্ছি। বাংলা হরফের স্থান দখল করে নিচ্ছে রোমান হরফ। কোন দিকে যাচ্ছে রক্তের দামে কেনা আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’, । যার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলাম আমারা।