সান রিপোর্ট:
সারাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা আর কেবলমাত্র ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমান প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর পদ্মাসেতুতে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা, যা নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থাৎ রাজধানীর যানজট এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির সমপরিমান টাকায় প্রতি বছর মুটামুটি তিনটি করে পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র রাজধানী ঢাকা এবং তা এককেন্দ্রীক। শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে উন্নত নাগরিক সেবার কথিত সব সুবিধা ঢাকাতেই। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে নাগরিক সেবার সব ধরণের কথিত সুবিধার সিংহভাগই ঢাকায়। কর্মসংস্থানের খোঁজেও মানুষ ছুটছে এই শহরের দিকেই। প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার ভাসমান মানুষ যোগ হচ্ছেন রাজধানীতে। কিন্তু মানুষের এই চাপ সামলাতে নেই কোন দীর্ঘমেয়াদী সুষ্ঠু পরিকল্পনা। যার কারণে তিলোত্তমা ঢাকার অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে যানজট।
রাজধানী ঢাকা শহরে স্বল্প দূরত্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে সীমাহীন দুর্ভোগের সঙ্গে অপচয় হচ্ছে সময়ের। দুই কোটিরও বেশি মানুষের এই শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন অপচয় হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘন্টা। আর সার্বিক হিসেবে এর আর্থিক ক্ষতির পরিমান বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
১২ বছর আগেও রাজধানীতে যন্ত্রচালিত যানবাহনের স্বাভাবিক গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। আর এখন একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার।
রবিবার ‘দি ফিউচার প্ল্যানিং আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে তাদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কথা জানিরেয়ছেন।
তারা বলেছেন, বিদ্যমান যানবাহনের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক নতুন নতুন যানবাহন। কিন্তু সড়কের বেহাল দশা ও সংখ্যা থেকে যাচ্ছে সেই আগের মতোই। যানজট কমাতে সরকার মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প হাতে নিলেও তার নির্মান কাজের কারণেই বরং নগরবাসীর দুর্ভোগ অবর্ণনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলমান পরিস্থিতি উত্তোরণে যেসব পরিকল্পনা বা সুপারিশ গৃহীত হয়েছে বা বা হচ্ছে তার বেশিরভাগই স্বপ্লমেয়াদী ও অদূরদর্শী, সমস্মিত পরিকল্পনা উল্লেখ্যযোগ্য দৃশ্যমান নয়। সাড়া দেশে যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা কিভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই যাত্রীসেবার মানও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, বেড়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনা ও সংখ্যা।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনাও দেশব্যাপী ক্যান্সারের মতো বিস্তার লাভ করছে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এই গবেষণা দুই বছর আগের। দু’দিন আগে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে- সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে সব মিলিয়ে বাংলাদশের জিডিপিতে ক্ষতি হচ্ছে ৩ থেকে ৫ শতাংশ। এটা আর্থিক ক্ষতির হিসাবে এক বিরাট অংক। যদিও সবার আগে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে ব্যক্তি, তারপর তার পরিবার, সবশেষে রাষ্ট্র।
দুর্ঘটনার কারণে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট যানজট অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। দুর্ঘটনা হ্রাসে সরকার পদক্ষেপ নিলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতার অভাবে এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)-এর পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। সড়ক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও সচেতনতার ওপর জোর দিতে হবে।
স্টকহোমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে তৃতীয় গোবাল মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তায় টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো কর্মসূচি না থাকা সড়কে উচ্চ মৃত্যু হারের অন্যতম কারণ।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের জন্য রাস্তাঘাট সুরক্ষার বিষয়টিকে জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এতে দেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করবে। সড়কে দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্ঘটনার বর্তমান প্রবণতা কমানো গেলে মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষতির পাশাপাশি দেশের আর্থিক ক্ষতি রোধ সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক এই সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ স্কেফার জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনা এখন শুধু মানবিক নয়, অর্থনৈতিক সমস্যা হয়েও দাঁড়িয়েছে।