নিজস্ব প্রতিবেদন:
সামাজিক জীবনমানের দিক দিয়ে ধনী-গরিবের যে পার্থক্য এটা আজীবনের । আর এ ব্যবস্থায় শুরু থেকেই সবদিক দিয়ে ধনিরা সর্বোচ্চ সুবিধাটুকু ভোগ করে আসছে। সে ধারাবাহিকতায় উচ্চ আয়ের মানুষদের তুলনায় গড় আয়ুতেও পিছিয়ে আছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
নিম্ন আয়ের পরিবারে একটি শিশু জন্ম নিলে তার গড় আয়ু হয় ৫৯, আর উচ্চ আয়ের ঘরে জন্ম নিলে তার গড় আয়ু হয় ৭৮ বছর। অর্থাৎ তাদের মধ্যে গড় আয়ুর পার্থক্য দাঁড়ায় ১৯ বছরের।
এমন তথ্য জানিয়ে ইউএনডিপি বলছে, জীবন-মৃত্যু, জ্ঞান-সুযোগ এবং জীবন-পরিবর্তনীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসমতা থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর একটি হোটেলে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) তাদের একটি বাংলা ফন্ট উদ্বোধন করে। এসময় বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে সংস্থাটি তাদের গত বছরের (২০১৯) মানব উন্নয়ন রিপোর্টের সার সংক্ষেপ বাংলায় প্রকাশ করে। যেখানে এমন তথ্য উঠে আসে।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান সময় মানুষের জীবনযাত্রার মনোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সফলতা প্রত্যক্ষ করছে। মানুষ সারা বিশ্বে বুভুক্ষ, ব্যাধি এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে ন্যূনতম জীবনধারণের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে। এই উন্নয়ন সূচক নির্দেশ করে যে, প্রত্যাশিত আয়ের ক্ষেত্রে মূলত শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এতে বহু মানুষকে পিছু পড়ে থাকতে হয়েছে এবং সব সক্ষমতার ক্ষেত্রে বহু অসমতা রয়েছে। এই অসমতাগুলো জীবন-মৃত্যু, জ্ঞান-সুযোগ এবং জীবন-পরিবর্তনীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মানুষের নিম্নগামী উন্নয়ন ও উচ্চতর উন্নয়নের সূচক দেশগুলোর মধ্যে গড় আয়ুর ফারাক ১৯ বছরের। বয়সের প্রতি ধাপে প্রত্যাশিত আয়ুর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ৭০ বছর বয়স মাত্রার নিম্ন ও উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচক দেশগুলোর মধ্যে প্রত্যাশিত গড় আয়ুর ফারাক প্রায় ৫ বছর। নিম্ন মানব উন্নয়ন দেশগুলোর মাত্র ৮২ শতাংশ মানুষ প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছে, যেখানে উচ্চতম মানব উন্নয়ন দেশগুলোতে এই হার ৯১ শতাংশ। শিক্ষার সব স্তরেই অসমতা রয়েছে। নিম্ন মানব উন্নয়ন দেশগুলোতে ৩.২ শতাংশ মানুষ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছে, যেখানে উন্নত দেশগুলোর ২৯ শতাংশ জনগণ উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত।
যারা পেছনে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে ৬০ কোটি মানুষ আয়ের দিক দিয়ে চরম দারিদ্র্যে বাস করে। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক পরিমাপ করলে তা এক লাফে ১৩০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ২৬ কোটি শিশু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাবৃত্তের বাইরে এবং ৫৪ লাখ শিশু ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। টিকাদান বা ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা সুবিধা সত্ত্বেও বিশ্বের দারিদ্রতম দেশগুলোর দারিদ্রতম গৃহাঙ্গনে শিশুমৃত্যুর হার এখনও বেশি।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, এই রিপোর্টে একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য আছে। তা হলো নিম্ন আয়ের ঘরে একটি শিশু জন্মালে তার গড় আয়ু হয় ৫৯ বছর। আর উচ্চ আয়ের ঘরে জন্মালে ওই শিশুর গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ বছর। অর্থাৎ জন্ম থেকেই নিম্ন ও উচ্চ আয়ের মধ্যে বৈষম্য শুরু হয়। বাংলাদেশ ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত আমাদের পাঁচ থেকে ১০ লাখ কোটি ডলার তহবিল প্রয়োজন হবে। এর একটি অংশ সরকার সরবরাহ করবে। বাকি অংশ বেসরকারি খাত ও উচ্চ আয়ের দেশ এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর দেওয়ার কথা রয়েছে।
তবে উচ্চ আয়ের দেশগুলো এখন স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশকে নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহায়তা দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বছর ঘোরে, অর্থনীতির উন্নতি হয়৷ কিন্তু লাভ হয় কেবল বড়লোকদেরই৷ গরিব মানুষের জীবনে কোনো উন্নতি নেই৷ সম্প্রতি আরেক রিপোর্টে এমনটিই জানিয়েছে অক্সফাম৷ তাদের রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালে মোট ধনের ৮২ শতাংশই সামান্য কিছু ধনী পরিবার লাভ করেছে৷ অথচ ৫০ শতাংশ গরিব মানুষের জীবনযাপনের কোনো উন্নতি হয়নি৷ অর্থাৎ, মোট উৎপন্ন ধনের কোনো অংশই গরিব মানুষের কাছে পৌঁছায়নি৷
নানা দিক থেকে গরিব-বড়লোকের ধনবৈষম্য দেখিয়েছে অক্সফাম৷ তাদের দাবি, ২০১৭ সালে রেকর্ড ২,০৪৩ জন বিলিয়নিয়ার তৈরি হয়েছে পৃথিবীতে৷ কিন্তু কীভাবে বিলিয়নেয়ারদের হাতে অর্থ আসছে? অক্সফামের দাবি, পরিশ্রম করে নয়, পারিবারিকভাবে অথবা সরকারের বদান্যতায়, অথবা গরিব মানুষকে শোষণ করে অর্থবানেরা আরও বেশি অর্থ উপার্জন করছেন৷ ফলে, তাঁদের অর্থ, সার্বিক ধনবন্টনে মোটেই সহায়ক হচ্ছে না৷
অক্সফামের এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর অবশ্য অন্যান্য বহু অর্থনৈতিক সংস্থা এর বিরোধিতা করে৷ বলা হয়, অক্সফামের রিপোর্ট পক্ষপাতদুষ্ট এবং অর্থনীতির অতিসরলিকরণ৷ বিরোধীদের বক্তব্য, চলতি বাজার অর্থনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে অক্সফাম একটি সহজ সত্য এড়িয়ে গিয়েছে৷ বিরোধীরা বলছেন, ১৯২৯ সালে পৃথিবীর মোট গরিব ছিল ৭৫ শতাংশ, সেই তুলনায় এখন দরিদ্র অনেক কমেছে৷ অর্থাৎ, গরিব মানুষের উন্নতি হচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বহুদেশে গরিবরা এখন কর্মস্থলে তাদের সুযোগসুবিধা, অধিকার বিষয়ে দাবি জানাতে পারেন৷
এ অবস্থায় উইএনডিপির এই গবেষনার তথ্য বিরোধীদের তথ্যতে সমর্থন করছে সেটা বলা যাবে না। এক্ষেত্রে বর্তমানে শিশু বিশেষজ্ঞরা বাস্তবতার নিরিখে বলছেন, শূন্য থেকে এক মাস বয়সী শিশুর মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। এই ঝুঁকি পাঁচ বছরের নিচে পর্যন্ত থেকে যায়। এক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা যথাযথ চিকিৎসা পায় না। যে কারণে তাদের মৃত্যুর হার বেশি।
বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রোটেকশন সেক্টরের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- নিম্ন ও উচ্চ আয়ের পরিবারের শিশুদের গড় আয়ুর যে পার্থক্য সেটি নানা করণে হয়ে থাকে। প্রথমত অপুষ্টি। অপুষ্টির সঙ্গে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির সম্পর্ক রয়েছে। আর রোগ-ব্যাধির কারণে মৃত্যু বেশি হয়। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো রোগের প্রতিষেধক সরকারি টিকাগুলো দেয়। তারা এর বাইরে অন্যান্য টিকাগুলো দিতে পারে না। আর উচ্চ আয়ের পরিবারের শিশুরা নয় বছর বয়স পার করলেই মেয়েরা ব্রেস্ট ক্যান্সারসহ নানা রোগের টিকা দিয়ে থাকে। যেগুলো অর্থ দিয়ে কিনে দিতে হয়। জটিল রোগে আক্রান্ত হলেও তারা উন্নত বা ব্যয়বহুল চিকিৎসার সুযোগ পায়। এই সুযোগটা নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে হয় না। চিকিৎসা নেওয়ার সক্ষমতার কারণেই এই পার্থক্যটা বাড়ছে।
সান নিউজ/সালি