নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মন্তব্য করে বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর-মার্চ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
আরও পড়ুন: বাকবিতণ্ডার ভিডিওর বিষয়ে যা বললেন সারজিস
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে আ’লীগ অংশ নেবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত দলটিকেই নিতে হবে। এছাড়া এ নির্বাচনে কারা কারা অংশগ্রহণ করবে তা নির্বাচন কমিশন (ইসি) সিদ্ধান্ত নেয়।
সংবাদমাধ্যমটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত বছর তার ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর দেশে নতুন সরকারের দায়িত্ব নিতে বলা হলে তিনি ‘চমকে’ গিয়েছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমার কোনও ধারণা ছিলো না যে, আমি দেশের সরকারের নেতৃত্ব দেব। আমি এর আগে কখনও সরকারি কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করিনি এবং এরপরও পরিস্থিতি বুঝে ঠিকভাবে কাজ করতে হয়েছিলো।
তিনি বলেন, এ সময় একবার এটি স্থির হয়ে গেলে আমরা অন্যান্য কিছু জিনিস সংগঠিত করতে শুরু করি। যার মধ্যে, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা এবং দেশের অর্থনীতি ঠিক করার জন্য অগ্রাধিকার ছিলো।
এর আগে, দেশের ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তারপর সেখানেই থেকে তিনি ভারতেই নির্বাসনে রয়েছেন। এ সময় নাটকীয় এই পটপরিবর্তনের পর একে একে করে বের হয়ে আসছে সাবেক সরকারের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ নানা চিত্র। হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, দাবি উঠেছে দল হিসেবে আ’লীগের বিচারেরও।
আরও পড়ুন: হাসিনাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে
এমন অবস্থায় এই বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করার আশা করছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। এরপর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সেখানেই নির্বাসনে থাকা হাসিনা এবং তার দল সেই নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তাও স্পষ্ট নয়। এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরত চাচ্ছে বাংলাদেশ।
অধ্যাপক ইউনূস রাজধানী ঢাকায় তার সরকারি বাসভবনে বিবিসিকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে বলেন, আ’লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা নির্বাচন করতে চায় কি না, আমি তাদের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করবে তা নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি বলেন, দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এবং এরপর অর্থনীতি। সাবেক সরকারের রেখে যাওয়া এক ছিন্নভিন্ন অর্থনীতি, বিধ্বস্ত অর্থনীতি। এটা এমন কিছু যেন ১৬ বছর ধরে কিছু ভয়ানক টর্নেডো হয়েছে এবং আমরা এখন টুকরোগুলো তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
বিবিসি তিনি বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন এবং নিপীড়কের মতো বা নির্মম উপাযে দেশ শাসন করেন। তার আ’লীগ সরকারের সদস্যরা নির্মমভাবে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালায়। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে হাসিনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা ও জেলে পাঠানোর ব্যাপক অভিযোগ ছিলো।
আরও পড়ুন: বঙ্গোপসাগরে ৫৬ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি
তবে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনে হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। এর পরে ছাত্রদের আহ্বানে ড. ইউনূস নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
ড. ইউনূস বলেছেন, তিনি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। তার এই সরকার কত দ্রুত সংস্কার করতে পারে তার ওপর নির্বাচনের সময়সীমা নির্ভর করছে। কারণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ সকল সংস্কারকে প্রয়োজনীয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যদি আমাদের ইচ্ছা মতো দ্রুত এই সংস্কার করা যায়, তাহলে চলিত বছরের ডিসেম্বরে আমরা নির্বাচন করতে পারবো। আর যদি সংস্কারের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
এদিকে, গত গ্রীষ্মে বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা সহিংস বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা থেকে এসেছি। এমন বিশৃঙ্খলা যেখানে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো।
কিন্তু প্রায় ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও রাজধানীর মানুষ বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা এখনও পুনরুদ্ধার হয়নি এবং পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ভালো একটি আপেক্ষিক শব্দ। উদাহরণস্বরূপ যদি আপনি গত বছরের এই একই সময়ের সাথে তুলনা করেন তবে আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে। এখন যা ঘটছে, তা অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা বা ভিন্ন কিছু নয়।
ড. ইউনূস বাংলাদেশের বর্তমান দুর্দশার জন্য আগের ফ্যাসিস্ট সরকারকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা হওয়া উচিত, তা আমি সমর্থন করছি না। আমি বলছি যে, আপনাকে বিবেচনা করতে হবে, আমরা কোনও আদর্শ দেশ বা আদর্শ শহর নই যা আমরা হঠাৎ করে তৈরি করেছি। এই অবস্থা হচ্ছে দেশের ধারাবাহিকতা যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, এমন একটি দেশ যেখানে এ সব বহু, বহু বছর ধরে চলছে।
আরও পড়ুন: তাপমাত্রা নিয়ে আবহাওয়ার বার্তা
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নৃশংস শাসনের শিকার মানুষ তার ওপরে ক্ষুব্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমেছে, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর মারাত্মক দমন-পীড়নের জন্য হাসিনার বিচারের দাবিতে। বাংলাদেশের একটি আদালত হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তবে তাকে ফেরত দেওয়ার বিষযে ভারত এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেখ হাসিনা ইউটিউবে ভাষণ দেবেন এমন এমন খবরে গত পুরো ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও হাসিনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ আ’লীগের সদস্যদের বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাংচুর এবং আগুন দেওয়া হয়েছিলো।
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে আ’লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহিংসতার ন্যায্যতা দেওয়ার অভিযোগ করেছে। বাংলাদেশ তাদের জন্য আর নিরাপদ নয় বলে আ’লীগের সদস্যদের দাবি সম্পর্কে বিবিসি জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে আদালত আছে, দেশের আইন আছে, থানা আছে, তারা সেখানে গিয়ে অভিযোগ করতে পারে, তাদের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারে। আপনারা অভিযোগ করতে কেবল বিবিসি সংবাদদাতার কাছে না গিয়ে অভিযোগ করতে দেশের থানায় যান এবং দেখুন আইন তার গতিতে কাজ করছে কিনা।
আরও পড়ুন: রাজধানীসহ বিভিন্নস্থানে ভূমিকম্প
এ সময় ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশি সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত এবং কার্যকরভাবে মার্কিন এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নকৃত প্রায় সকল কর্মসূচি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মতো দেশে প্রভাব ফেলবে।
ড. ইউনূস বলেন, এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, এটি ভালোই হয়েছে। কারণ তারা এমন কিছু করছে যা আমরাই করতে চেয়েছিলাম, যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং এর মতো আরও জিনিস, যা আমরা কখনোই ঠিকভাবে (মোকাবিলা) করতে পারিনি।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারি উন্নয়ন সহায়তার ৩য় বৃহত্তম সরবরাহকারী। বিগত বছর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। কিভাবে এই ঘাটতি পূরণ করা হবে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, যখন এটা হবে, আমরা তা পূরণ করব।
সান নিউজ/এমএইচ