নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব চীনের পাশাপাশি পড়তে শুরু করেছে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে। সংকুচিত হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিধি। চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে বেড়ে যেতে পারে বেকারত্ব আর মূল্যস্ফীতি। এরই মধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে, যথা সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর।
এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চীনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যবসায়ীক দিক দিয়ে সারা বিশ্বের অনেক দেশ চীন থেকে পণ্য আমদানী-রপ্তানীও বন্ধ রেখেছ।
দেশটির স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, একেবারে তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে চীনের অর্থনীতি। বলা হচ্ছে, ৩০ বছরের ইতিহাসে সব থেকে তলানিতে এখন দেশটির অর্থনীতি। যা চীনের জন্য বড় এক ধাক্কা। চীনের শেয়ার বাজারেও বড় ধস নেমেছে।
চীনের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত একমাসে করোনাভাইরাসের কারণেই ৪২০ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ৩৩ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্ববাজারে কমে গেছে জ্বালানি তেলের দাম, বিশ্বের প্রধান ও প্রভাবশালী সব শেয়ারবাজারও নিম্নমুখী, ধাক্কা খেয়েছে চীনসহ আন্তর্জাতিক পর্যটন শিল্প।
গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ১৫ শতাংশ। গত তিন মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য সর্বনিম্ন সূচকে অবস্থান করছে। মার্কিন ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস জানিয়েছে, চলতি বছর জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা কমে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে পর্যায়ে নামতে পারে।
করোনা ভাইরাসের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের উৎপাদন-বাণিজ্যে পড়া শুরু করেছে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বড় প্রকল্পগুলো।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, চীনা প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো নিয়ে এক ধরণের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গেল সপ্তাহেই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রকল্পগুলোয় এখনো করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তবে ভাইরাস সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হলে তার বিরুপ প্রভাব পড়বে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসংযোগ, কক্সবাজার-দোহাজারি রেলরুট, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্পে চীনের কয়েক হাজার ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও শ্রমিক যুক্ত আছেন।
এসব প্রকল্পে কাজ করা চীনা নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ চীনের নববর্ষ বা বসন্ত উৎসব উপলক্ষে ছুটিতে যান । তাদের ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও কাজে যোগ দিতে পারছেন না। কারণ সে ক্ষেত্রে তাদের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের মধ্যেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তাদের ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আর যারা ছুটি কাটিয়ে ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন, তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বাংলাদেশে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বলেন, পদ্মা প্রকল্পে কর্মরত ১১০০ চীনা নাগরিকের মধ্যে কমপক্ষে আড়াইশ ছুটিতে আছেন। পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ এমনিতেই অনেক পিছিয়ে আছে। এই প্রকল্পে ৮৫৫ জন চীনা কর্মী যুক্ত। এর মধ্যে ৩৬৬ জন ছুটিতে গেছেন নববর্ষ উদযাপনে। এর মধ্যে ফিরেছেন মাত্র ১৬ জন।
এদিকে আগামী মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করার কথা রইলেও তা পিছিয়ে যেতে পারে। পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীন থেকে ছুটি কাটিয়ে দেশে ফেরা সেদেশের ২০ নাগরিককে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে।
চীনা অর্থায়নে দেশটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ চলছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের। আগামী ৩ বছর পর এটি চালু হওয়ার কথা। কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এই কাজও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে সেতু মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমানে চীন থেকে পণ্য জাহাজীকরণ, বুকিং এবং বিক্রি আপাতত বন্ধ। যেসব পণ্য দেশে আসছে সেগুলো এক মাস আগেই বুকিং করা। অন্যদিকে বাংলাদেশও চীনের নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করেছে। চীন থেকে পণ্য আমদানি করে যারা বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করেন তারাও অনেকে বন্ধ করে দিয়েছেন আমদানি।
সামগ্রিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীনের করোনা ভাইরাসের স্বল্পকালীন প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। আবার যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল নির্ধারিত সময়ে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। রোগটির প্রভাব বাড়লে পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে বলে জানান তিনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত দশ বছরে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
এদিকে ক্রমাগত দর হারাচ্ছে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিশ্ব শেয়ারবাজারে। নিম্নমুখী প্রবণতায় গত সপ্তাহ শেষ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ শেয়ারবাজার। জার্মানির শেয়ারবাজার ডেক্স ইনডেক্স এর সূচক ০.৪৫ শতাংশ বা ৬১.০১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৩৫১৩.৮১ পয়েন্টে। ইতালিতে ০.০৫ শতাংশ বা ১২.০৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২৪৪৭৮.৩২ পয়েন্টে। নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে এশিয়ার শেয়ারবাজারেও। জাপান, হংকং, ভারতের শেয়ারবাজারগুলোতে নিম্নমুখী প্রবনতা স্পষ্ঠ।
বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস, আর্থিক ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা চীন থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কমছে শিল্পখাতের কার্যক্রম ও খুচরা বিক্রি।
প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে আসেন লাখ লাখ চীনা পর্যটক। কিন্তু এবারের চিত্র স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন। পর্যটন কেন্দ্রগুলো একেবারেই ফাঁকা। চীনা পর্যটকদের অন্য দেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় চলতি বছর নিউইয়র্ক আর ক্যালিফোর্নিয়া লোকসান গুণতে পারে প্রায় ৬শ কোটি ডলার। চীনা পর্যটকরা অন্য যেসব দেশের পর্যটন খাতে অনন্য অবদান রাখেন, প্রায় সব দেশকেই এবার গুণতে হবে কঠিন লোকসান। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ অধিকাংশ দেশেই ধস নামতে শুরু করেছে পর্যটন খাতে।
বাংলাদেশরে ভ্রমণ পিপাসু ইফতি আজাদ জানান, থাইল্যান্ডে যাওয়ার কথা থকলেও করোনা ভাইরাসের কারণে যাওয়া হচ্ছে না। তিন বছর আগে তিনি থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। যে হোটেলে ছিলেন সেখান থেকে তাকে মেইল করেছে কর্তৃপক্ষ। তারা অফার দিচ্ছে এখন থাইল্যান্ড ভ্রমণ করলে ৫০ শতাংশ কম খরচে হোটেলে থাকা যাবে। এ অফারের পরও যেতে আগ্রহী নন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ অনেক দেশে চীনাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমেরিকান এয়ারলাইন্স, ডেল্টা এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স চীনে ফ্লাইট বাতিল করেছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের এভিয়েশন বাজারের ২৫ ভাগ চীনের দখলে। করোনা ভাইরাসের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এই বাজার। ইতোমধ্যে বিশ্বের ২৭টি এয়ারলাইন্স তাদের ফ্লাইট বাতিল করেছে চীনের সঙ্গে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের সঙ্গে ফ্লাইট আপাতত বন্ধ করা প্রয়োজন।