বিশেষ প্রতিনিধিঃ
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক ছিল অনেক, এখনও রয়েছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুতের চড়া মূল্য, কয়লাভিত্তি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়ে পরিবেশবিদ এবং পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ কিংবা পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের একাংশের বিতর্কের মধ্য দিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহুমুখী পদক্ষেপে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় কাজ করে চলেছে বর্তমান সরকার।
বিশ্বের ১৩ শতাংশ মানুষ এখনও বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর বর্তমানে বাংলাদেশে এই সুবিধা পাচ্ছেন ৯৬ শতাংশ মানুষ। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবেন দেশের শতভাগ মানুষ।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) গণভবনে এক অনুষ্ঠান থেকে সে কথা আবারও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিববর্ষে কেউ অন্ধকারে থাকবে না, সব ঘরেই আলো জ্বলবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঘর থেকে ঘরে শুধু আলো জ্বলে ওঠাই নয়, বিদ্যুতের দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে আরও দ্রুত গতিতে। বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব পড়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে। এতে অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হয় প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যদিও বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরণের দুর্নীতি নিয়েও রয়েছে অনেক ধরণের অভিযোগ।
তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই মহাযজ্ঞের মধ্যেও সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার বিষয়টি সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৬১ পয়সা। এ ব্যয় এখন ৬ টাকা ২৫ পয়সায় গিয়ে ঠেকেছে। এ সময় বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৩৯ শতাংশ।
সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশ এখন বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ থেকে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে বলে দাবি সরকারের। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪৩ তম’তে। মাত্র এক দশক আগে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। আর এখন তা ২ কোটি ৬২ লাখ। ৫৫ লাখ মানুষ পেয়েছেন সৌর বিদ্যুৎ সুবিধ, যাদের কাছে জাতীয় গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কোন উপায়ই ছিল না। বেড়েছে বিদ্যুতের মাথাপিছু ব্যবহারও, যা প্রায় ১৩১ শতাংশ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই হার ছিল ৪৭ শতাংশ।
দেশে প্রথমবারের মতো দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটার সাগর তলদেশে সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করে দেশের মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। গত বছরের অক্টোবরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোডে হিসেব মতে, এমন দুর্গম চর ও দ্বীপের সংখ্যা চিহ্নিত করা হয় ১১৪৬টি গ্রাম। নদীর ভেতর বিতরণ খুঁটি স্থাপন (রিভার ক্রসিং) ও নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেব্ল স্থাপনের কাজ শুরু হয় এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে । আর এই গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পারলেই দেশের কোনো মানুষই আর বিদ্যুত সুবিধার বাইরে থাকবে না বলে জানিয়েছে আরইবি।
সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন উন্নয়ন বোর্ডের (আরইবি) ৮০টি সমিতি। দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা আরইবির কার্যক্রম রয়েছে ৬১ জেলার ৪৬১টি উপজেলায়। এসব এলাকার ৮৪ হাজার ৮০০ গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ইতিমধ্যে ৮১ হাজার ৬০৬টি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিদ্যুতের উন্নয়নে ৪০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান) করে। সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নতুন গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়। আর ২০১৬ সালে নেওয়া হয় ক্রাশ প্রোগ্রাম ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা। তবে মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এক বছর আগেই প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে আলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, ২০০৯ সালে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬ হাজার মেগাওয়াট, ঘাটতি ছিল এক হাজার মেগাওয়াট। গ্রীষ্ম মৌসুমে লোড শেডিং হত ৮ থেকে ১০ ঘন্টা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন দেশের ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদুতের পরিমান ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০০ মোগাওয়াট। বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ছিল দেশের মোট জনগোষ্ঠির ৪৭ শতাংশ। ১০ বছর পর এসে ১৩৭ টি কেন্দ্র থেকে সেই উৎপাদন চলে গেছে ১২ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। গত বছর ২৯ মে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড দাঁড়ায় ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ সচিব ড. সুলতান আহমেদ বলেন, সরকার বিদ্যুতের উন্নয়নের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বলেই বিদ্যুৎ খাতের এই ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার লক্ষ থাকলেও মুজিব বর্ষ উপলক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের এক বছর আগেই এই কাজ সফল করা সম্ভব বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগই এখনও আসছে গ্যাস থেকে। গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে সরকার বিকল্প নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে। কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েক কেন্দ্রের কাজ চলছে জোরেশোরে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে পাবনার রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের একটি বড় অর্জন। ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও, ঐ সময়ের মধ্যেই ৩৩,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।