নিজস্ব প্রতিবেদক:
খুলনা: করোনায় সুন্দরবনে পর্যটন খাতে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্ধের উপক্রম ১৭০টির বেশি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান এবং লঞ্চ, ট্যুরবোট, ট্রলারসহ সহস্রাধিক নৌ-যানের প্রায় তিন হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মহীন। সবমিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খুলনা ও মোংলায় এই সেক্টরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ৩০ হাজার মানুষ। সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।
অপরুপ নেসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জগদ্বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও রয়েছে হরিণ, বানর, কুমির, গুইসাপ ও সরীসৃপসহ নানা প্রজাতির স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী। রয়েছে হরেক রকমের পাখি এবং সুন্দরী, গরান ও গেওয়াসহ নানা জাতের গাছ। সবমিলে অপার সৌন্দর্যে ভরা লীলাভূমি সুন্দরবন।
প্রকৃতির নৈসর্গিক এ সৌন্দর্য অবলোকনে দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের সমাগম হতো সুন্দরবনে। প্রকৃতিপ্রেমীরা নির্মল নির্ভেজাল বাতাসে নিশ্বাস ও একটু আনন্দ নিতে এ বৈচিত্র্যের মাঝে ছুটে আসেন। করমজল, কটকা, কচিখালি, হারবাড়িয়া, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, আলোর কোল, নীল কমলসহ সমুদ্র তীরবর্তী বনাঞ্চলের ছোট ছোট নদী-খালের জলরাশিতে লঞ্চ, ট্যুরবোট, ট্রলারসহ নানা ধরনের নৌ-যানে চড়ে বছরজুড়ে যাতায়াত থাকে দর্শনার্থীদের। আর এ সুন্দরবনে পর্যটন খাতকে ঘিরে খুলনা-মংলাসহ আশেপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে হাজারো লোকের কর্মসংস্থান। কিন্তু করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় হঠাৎ করে সবকিছু থমকে যায়। গত ১৯ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটকের আনা-গোনা। সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থানগুলোতে তাই এখন সুনশান নীরবতা।
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে অনেক ট্যুর অপারেটরস প্রতিষ্ঠান। প্রায় ছয়মাস ধরে বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থাভাবে ধুঁকছে, তাদের প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কর্মহীন। পর্যটন ব্যবসায় জড়িত লঞ্চ, জালিবোট, ট্যুরবোট, ট্রলারসহ সহস্রাধিক নৌ-যান অলস বসে থাকায় সেগুলোরও আরো সহস্রাধিক শ্রমিক-কর্মচারী বেকার। সব ধরনের নৌ-যান নষ্ট হতে চলায় ব্যবসায়ীদেরও পথে বসার উপক্রম। বনের দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় পল্টুন, কাঠের পুলসহ নানা স্থাপনা নষ্ট হচ্ছে, অনেক স্থানে খসে পড়েছে। এদিকে নজরদারিও কমে গেছে বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
সুন্দরবন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় খুলনায় ৭০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০০ স্টাফ ও এক হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। খুলনা-মংলায় আরো শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে সুন্দরবন ট্যুর অপারেটরস কাজে। দীর্ঘ ছয়মাস বন্ধ থাকায় প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ট্যুর অপারেটরস প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সভাপতি মঈনুল ইসলাম জমাদ্দার ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম ডেভিড বলেন, দেশের সকল পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে সুন্দরবন এখনও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। চরম আর্থিক সংকটে আমাদের ৭০টি ট্যুর প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার স্টাফ ও শ্রমিককে বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। গত ছয়মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার লোকসান গুণেছেন ব্যবসায়ীরা।’
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মুঈন উদ্দিন খান জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে ১৯ মার্চ থেকে সুন্দরবনে পর্যটকসহ নৌ-যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম সুন্দরবনজুড়ে এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য প্রবেশের বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সহসাই সুন্দরবন পর্যটকদের জন্য খোলা হচ্ছে না। এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় শুধু সুন্দরবন নয়, সব সংরক্ষিত বন এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর হাতে।
এদিকে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন অবমুক্ত করে দেওয়ার দাবিতে প্রায়ই নানা কর্মসূচি পালন করছে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন। গত বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) খুলনা মহানগরীর বয়রাস্থ বনবিভাগের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মঈনুল ইসলাম জমাদ্দার ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম ডেভিড জানান, দ্রুত সুন্দরবনের পর্যটনশিল্প খুলে দেওয়া না হলে খুলনা ও ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।
মানববন্ধন শেষে সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মুঈন উদ্দিন খানের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে অ্যাসোসিয়েশনের দাবি তুলে ধরার আশ্বাস দেন।