ভাষা আন্দোলনের মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের মধ্যে রফিকউদ্দিন অন্যতম । রফিকের জম্ম মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিল বলধারায় । তিনি জম্মেছেন ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর । তাঁর শহিদস্মৃতি পরবর্তীকালে বাঙালি জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেমে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় । পরবর্তীতে বাংলাভাষা পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান ।
প্রাথমিক জীবন ও পরিবার
রফিকউদ্দিনের পিতার নাম আবদুল লতিফ ও মাতার নাম রাফিজা খাতুন । তাঁর পিতা আবদুল লতিফ ছিলেন ব্যবসায়ী, কলকাতায় ব্যবসা করতেন । রফিকরা ছিলেন পাঁচ ভাই ও দুই বোন । ভাইদের মধ্যে রফিক ছিল সবার বড় । শৈশবে গ্রামের স্কুলেই তিনি লেখা -পড়া করেন ।
রফিক বাল্যকালে কিছুটা ডানপিটে ছিলেন । তাই গাছ থেকে পড়ে তার হাত ভেঙে গেলে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান। কলকাতা অবস্থানের সময় মিত্র ইনস্টিটিউশনে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রফিকউদ্দিনের পিতা ঢাকায় চলে আসেন।
এখানে এসে রফিক বায়রা স্কুল ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বায়রা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে রফিকউদ্দিন মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্যে বিভাগে ভর্তি হন। আই.কম. পর্যন্ত পড়লেও পরে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় এসে পিতার সঙ্গে প্রেস পরিচালনা করতে শুরু করেন। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ( বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। পরে ১৯৫২ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
শহীদ রফিক সাহিত্য অঙ্গনে ছড়া, রচনায় দক্ষ ছিলেন এবং সেলাই ও সূচিশিল্পেও বেশ দক্ষ ছিলেন । সমাজকল্যাণেও তিনি পভীর আগ্রহী ছিলেন। শহীদ রফিকের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল গণআন্দোলনে নিজেদের গভীরভাবে যুক্ত করেছেন। তাইতো ১৬৬৯ - এর গণআন্দোলনে ও জীবন দিয়েছেন এই পরিবারের সদস্য জনাব ইসহাক । রফিকের ভাই আব্দুস সালাম ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা । তিনি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন ।
রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খানের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ২০ ফেব্রুয়ারী রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত রফিক গল্পগুজব করেছিলেন তার সাথে। পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারীর যে মিছিল হবে, সে মিছিলে যোগ না দেয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারী বিকেল ৩ টায় ছিল পুর্ববঙ্গ বিধান সভার অধিবেশন। ছাত্রছাত্রীরা চেয়েছিলেন বিধান সভার সদস্যদের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করাতে। আর গণপরিষদে তা পাশ করানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে সদস্যদের ইস্তফা দিতে বলবে।
যেভাবে শহীদ হলেন
বাবার ব্যবসা আর জগন্নাথের হিসাববিজ্ঞান লেখাপড়া সবখানে তালগোল পাকিয়ে গেছে। এখন মাথায় লেখাপড়া বা ব্যবসা কোনোটিই কাজ করে না। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা বাংলাভাষা। পাকিস্তানীদের এতো বড় সাহস যে বাঙালীর মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। তারা ভেবেছে কারফিউ দিয়ে, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে আমাদের ঠেকিয়ে রাখবে। তা হতে দেয়া যায় না।
পাকিস্তানিদের প্রতি বুক ভরা ক্রোধ নিয়ে রফিক মিশে যায় ২১ ফেব্রুয়ারী মিছিলে। ১৪৪ ধারা ভাঙতে সামনে এগিয়ে যায়। বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র- জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশ গুলি চালালে সেই গুলি রফিকউদ্দিনের মাথায় লাগে। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলে তাঁর মৃত্যু হয়। মেডিকেল হোস্টেল এর ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়া ছিল। ছয়- সাত জন ধরাধরি করে তার লাশ ঢাকা মেডিকেলের এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। রফিকই প্রথম ভাষা শহিদ। শহিদ রফিকের বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে বিয়ে করাবেন। সে ইচ্ছে পুরণ হয়নি।
১৯৫২ সালপর ২১ ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে এক আত্মীয়ের নিকট থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে ছেলের শহিদ হবার সংবাদ জানতে পেরেছিলেন। পরদিন তিনি ছেলেকে দেখার জন্য ঢাকা ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু সে আশাও পুরণ হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন পুত্রের কবর শনাক্ত করতে। কিন্তু কবর শনাক্ত করে যেতে পারেননি। ভাষাশহীদরা জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলা বর্ণমালার সম্মান। আমরা পেয়েছি শহীদ মিনার।
মৃত্যু পরবর্তী সম্মাননা
রফিকউদ্দিন ও অন্যান্য ভাষা শহিদ - সালাম, জব্বার, শফিউরের মহান আত্মাত্যাগের ফলেই বাংলাভাষা ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করে। তাঁর শহিদ স্মৃতি উত্তরকালে পুর্ববঙ্গবাসিদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই চেতনার ভিত্তিতেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় আবদান রাখার জন্য ২০০০ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।
শহীদ রফিকের রক্ত বাঙালিরা বৃথা যেতে দেয়নি। শহিদ রফিক যেদিন ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন সেই ২১ শে ফ্রেুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: আলী ইমাম