শিশু স্বর্গ

“শিশু হও, শিশুর মতো হও”- বঙ্গবন্ধু

মঞ্জুরুল আলম পান্না:

বঙ্গবন্ধু কেবল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রই জন্ম দেননি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে মাথা উঁচু করে টিকে রইবে, তাঁর দার্শনিক ভাবনা থেকেই করে গেছেন অনেক কিছু। “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে।” দেশকে যুগে যুগে যোগ্য নেতৃত্বের হাতে নিরাপদে রাখতে প্রতিটি শিশুকে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন আগামীর ভবিষ্যৎ হিসেবে। এমন চিন্তার অসংখ্য প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কন্টকার্কীর্ণ দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে। দেশ গঠনে রাজনীতির কঠিন অধ্যায়ের বিকল্প যে শিশুদের জন্য কাজ করা তারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনিই দেখিয়েছেন।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে দেশের ক্ষমতা দখল করে পাঁচ বছরের জন্য দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেন। শেখ মুজিবসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে রাখলেন কারাগারে। তবে গ্রেপ্তারের পূর্বমুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান তরুণদের দিয়ে গেলেন এক যুগান্তকারী নির্দেশ। বললেন, ‘এই পাঁচ বছর তোমরা শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে কাজ করো। নিজেদের সচল রাখো।’

বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশের মাত্র দুই বছর আগেই দেশের ঐতিহ্যবাহী এই শিশু সংগঠনটির জন্ম। একারণেই তাঁর এমন নির্দেশ। তিনি বিশ্বাস করতেন- শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মা, মাটি আর মানুষকে ভালোবাসার মানসিকতার বিকাশে একটি আদর্শিক শিশু সংগঠন অপরিসীম ভূমিকা রাখতে পারে। কচি-কাঁচার মেলার মতো প্রগতিশীল একটি শিশু সংগঠনের মাধ্যমে সে কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। হয়তো তাঁর ভাবনায় ছিল, আজ রাজনীতির যে দুর্গম যাত্রা, সেখানে নিজেরা কিছু করতে ব্যার্থ হলেও যোগ্য নাগরিক হয়ে সেদিনের শিশুরাই আঁধার রাত্রীর দিশা হবে একদিন।

১৯৬৩ সাল। আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবেই ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে কচি-কাঁচার মেলা আয়োজিত শিশু আনন্দমেলায় এসেছিলেন শিশুবন্ধু হয়ে। উচ্চারণ করলেন এক শাশ্বত সুন্দরের বাণী। বললেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের কোন একদিন কচি-কাঁচার মেলার ক্ষুদে বন্ধুরা তাদের আঁকা কিছু ছবি নিয়ে যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে। ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবিগুলোতে ফুঁটে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য। শিশুদের সঙ্গে ছিলেন রোকনুজ্জামান দাদা ভাই। আবেগে আপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধু তখনই জানালেন, এই ছবিগুলো তিনি নিয়ে যেতে চান রাশিয়া সফরে সেদেশের শিশুদের জন্য বাংলাদেশের শিশুদের উপহার হিসেবে। অন্যরকম এক ভালবাসায় তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না।’

সংগ্রামী জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের জন্য ভাবতেন। শিশুদেরকে আনন্দ আর হাসি-খুশিতে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। শিশুদের সান্নিধ্য তাঁকে দিত সব অবসাদ থেকে মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক ভালোবাসায় দেশের শিশু সংগঠনগুলো হয়েছে বর্ণিল। সুযোগ পেলেই যেতেন খেলাঘর, কচি-কাঁচার মেলাসহ অন্যান্য সংগঠনের শিশুদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা সমাবেশে। তাদের নাটক, মার্চপাস্ট, লাঠিখেলা, সবকিছু উপভোগ করতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। অতি সহজে প্রগাঢ় ভালবাসায় মিশে যেতেন শিশুদের সঙ্গে। তাঁর সান্নিধ্যে শিশুরাও যেন অনুভব করত নিবিড় প্রশান্তি, আপন হয়ে উঠত খুব কম সময়েই।

বিভিন্ন কাজে বঙ্গবন্ধু যখন গ্রামেগঞ্জে যেতেন, চলার পথে শিশুদের দেখলে গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন। খোঁজখবর নিতেন। দুস্থ ও গরিব শিশুদের দেখলে কাছে টানতেন। কখনও বা নিজের গাড়িতে উঠিয়ে অফিসে বা নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। দিতেন কাপড়-চোপড়সহ নানান উপহার। চেষ্টা করতেন সব শিশুর মুখে হাসি ফোটানোর। শিশুদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুয়ার ছিল অবাধ। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের জন্য কিছু করার আগ্রহ ছিল তার প্রবল। তিনি মনে করতেন, শিশুদের প্রাণে জাগাতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে নতুন থেকে নতুনের দিকে এগিয়ে চলার যে শিক্ষা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক, সেই শিক্ষাই ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন শিশুর অন্তরে।

একটি ঘটনার কথা এই স্বল্প পরিসরে তুলে না ধরলেই নয়। ১৯৭২ সালের শেষের দিকের কথা। একদিন সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন, যেমনটি রোজ বের হতেন। সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। হঠাৎ একটি বাচ্চা ছেলেকে চোখে পড়ল বঙ্গবন্ধুর। দেখলেন- কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ছেলেটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু কাছে ডাকলেন ছেলেটিকে। জানতে চাইলেন, কেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে? ছেলেটি জানালো- তার পায়ে কী যেন ফুটছে, এ জন্য ব্যথা করছে। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে ছেলেটির পায়ের জুতা খুলে দেখেন তার ভেতর লোহার সুচালো মাথা বের হয়ে আছে। যার খোঁচায় পা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু তখনই ছেলেটির চিকিৎসার জন্য তাঁর দেহরক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিলেন। কিছু টাকাও দিলেন তার হাতে। পরম মমতায় আদর করে ছেলেটিকে বিদায় নিলেন। এমন ঘটনার অসংখ্য নজির আছে বঙ্গবন্ধুর জীবনে।

বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেননি, একজন নেতা হয়ে উঠছেন কেবল, তখনও তিনি তার পরিকল্পনায় শিশুবান্ধব সিদ্ধান্ত রাখতেন। আর রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা হাতে আসার পর শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার দেয়া হল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে। শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে করা হয় জাতীয়করণ।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সমাজ, মানুষ আর মানুষের রাজনীতির মধ্যে যত বিভেদই তৈরি হোক না কেন, প্রতিটি শিশুকে সাম্য ও সমতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদের গড়তে হবে। শিশুদের সুরক্ষায় পূর্ণাঙ্গ একটি আইনই করে ফেললেন তিনি। ১৯৭৪ সালের ২২ জুন প্রণীত হয় জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট)। এই আইনের মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিশুদের প্রতি সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অহিংসা দিয়ে, মানবপ্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সমাজে যে আদর্শ বঙ্গবন্ধু নির্মাণ করে গেছেন তার মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ তাঁর এই কথার অর্থ কী আমরা বুঝি এখনও?

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নলছিটিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠির নলছিটিতে শুরু হয়েছে ভূট্টো স্মৃত...

স্বামীর মুঠোফোনে সাবেক প্রেমিকের ম্যাসেজ-ভিডিও, নববধূর আত্মহত্যা

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর সুবর্ণচরে স্বামীর মুঠোফোনে সা...

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক : নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য তোফায়েল আহ...

বাজার সহনশীল করার চেষ্টা করছি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমে এসেছে জ...

বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৩ জনের মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি: গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃ...

ডেঙ্গুতে একদিনে বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ১১ জনের মৃত...

অটোরিকশার বিষয়ে যে বার্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক: উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অটোরিকশা সম...

পেপার মিলে অগ্নিকাণ্ড, দগ্ধ ১১

জেলা প্রতিনিধি: নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের একটি পেপার মিলে অগ্...

পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, নিহত ২১

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবারপাখ...

আমরা সব লিপিবদ্ধ করে যাবো

বিনোদন ডেস্ক: অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা