মঞ্জুরুল আলম পান্না:
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম। সংক্ষেপে জেএন ইসলাম। নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ একজন বিজ্ঞানী। একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ এই মানুষটি দেশের মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত না হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশকে জানতো জেএন ইসলামের দেশ হিসেবেই। আধুনিক বিশ্বের কাছে বিস্ময় হিসেবে পরিচিত যে স্টিফেন হকিং, সেই হকিং-এর চেয়ে জোমাল নজরুল ইসলামকে আরও বড় বিজ্ঞানী মনে করেন অনেকে। তিনি ছিলেন ক্যাম্ব্রিজে হকিংয়ের রুমমেট, বন্ধু এবং সহকর্মী। আধুনিক বিশ্বে নোবেল নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক। সেই বিতর্কের অংশ করা যেতে পারে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামকে। নোবেল কমিটির মনোনয়ন তালিকায় একাধিকবার বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞািনীর নাম এলেও শুধুমাত্র প্রচারের অভাবেই সম্ভবত বিশ্বের সেরা পদক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মৌলিক বিজ্ঞানে তাঁর মতো অবদান আর কারোর নেই। বিশ্ববিখ্যাত এই বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৯ সালের এদিনে বাংলার এই নক্ষত্রের জন্ম হয় বাবার কর্মস্থল ঝিনাইদহে।
আধুনিক বিশ্বের সেরা সাত বিজ্ঞানীর মধ্যে বাংলার জেএন ইসলামও যে অন্যতম, তা আমরা অনেকেই জানিনা। ২০০১ সালে পৃথিবীর প্রায় সকল বিজ্ঞানী বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সে সময় তিনি গণিতের হিসাব কষে পৃথিবীর মানুষকে আস্বস্ত করে বলেছিলেন, সে রকম কোনো আশঙ্কা নেই।
কারণ, সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ কখনো এক সরলরেখায় এলে পৃথিবীর ওপর তার প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। গবেষণায় অধ্যাপক ইসলাম আশার কথা শুনিয়েই বললেন— সে রকম ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বিজ্ঞানে তাঁর মত কাব্যিক গবেষণা খুব কমই রয়েছে। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কী, তা নিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম করেছেন বিশ্বমানের গবেষণা। বর্তমানে অনেকেই মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করছেন কিন্তু তিনি যে সময়ে এ কাজ করেছেন, তখন খুব বেশি কেউ এই ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করেননি। বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম রেডিও আবিষ্কার করলেও তার কৃতিত্ব চলে যায় মার্কনির কাছে। ঠিক তেমনটি ঘটেছে জেএন ইসলামের ক্ষেত্রেও। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের লেখা ‘কৃষ্ণবিবর’ গ্রন্থটি হকিং-এর ব্ল্যাকহোল থিউরির অনেক আগেই প্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু হয়। কিন্তু আমরা কেউ তা জানি না। জানলেও তা প্রচারে ছিল আমাদের উদাসীনতা কিংবা কার্পণ্য। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় হকিং-কে নিয়ে যতোটা লেখালেখি হয়েছে তার ছিটেফোটাও হয়নি আমাদের জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে। জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ লেখা হয়েছে ১৯৮৩ সালে। আর হকিংয়ের ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ লেখা হয়েছে ১৯৮৮ সালে। দুটি গ্রন্থ তুলনা করলে নিঃসন্দেহে জেএন ইসলামের বইটি যে কোনো বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন অনেক পদার্থবিদ। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর সুসানা বলেছেন, ‘বিজ্ঞানময়তা বিবেচনায় হকিংয়ের অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম-এর চেয়ে অনেক গুণ কার্যকর এবং বিজ্ঞানানুগ হচ্ছে জেএন ইসলামের দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স।’ কিন্তু ‘ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ নিয়ে যে তোলপাড় হয়েছে বিশ্বব্যাপী, জেএন ইসলামের আল্টিমেট ফেইট নিয়ে তার কিছুই হয়নি, এমন কি অধ্যাপক ইসলামের স্বজাতি বাঙালিও দেয়নি তার যোগ্য সন্মান। তবে জেএন ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে হকিং নিজেই বলেছিলেন, ‘জেএন ইসলাম আমার রুমমেট, বন্ধু এবং আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক।’
ছোটবেলা থেকে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন অসম্ভব মেধাবি। ২০ বছর বয়সেই তিনি দু’বার বি.এসসি করে ফেলেন (লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজে ২য় বার বি.এসসি করেছিলেন)। এরপর বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ট্রাইপজে তিন বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করেন। ১৯৬০ সালে কেমব্রিজ থেকেই মাস্টার্স। ১৯৬৪ সালে এখান থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ড. ইসলাম অত্যন্ত দুর্লভ ও সম্মানজনক ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ডক্টরেট সম্পন্ন হবার আগেই পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায় যোগ দেন তিনি। সাধারণত ডক্টরেট সম্পন্ন হবার আগে পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা করা যায় না। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই পিএইচ.ডির কাজ শেষ করে ফেলেন তিনি।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন জেএন ইসলাম । ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন তিনি। ১৯৭১-৭২, এই দুই বছর ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কাজ করেছেন ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে। এরপর ১৯৭৩ থেকে দুই বছরের জন্য ছিলেন লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মনে সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন বাংলার এই বিস্ময়।
১৯৮৪ সালে প্রফেসর ইসলাম নিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। পশ্চিমের উন্নত দেশে ৩০ বছরের অভ্যস্ত জীবন, লোভনীয় চাকরি, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহচর্য সবকিছু ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে এলেন তাঁর অপার ভালবাসার মাতৃভূমিতে। অনুভব করলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। দেশপ্রেমিক এই মানুষটি নিজ দেশের শিক্ষার্থীদেরকে বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণায় উজ্জীবিত করার জন্য দেশের সেবায় নিয়োজিত করলেন নিজেকে । অতি দামি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দিলেন মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে।
নিজের একটি লেখায় তিনি বলেছেন, ‘স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এর ভিন্নতা ঘটেনি কখনোই। আরেকটা দিক হলো বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থা সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব ছিল না।’
দেশে ফিরে এসে একদিকে জামাল নজরুল ইসলাম গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান ‘রিচার্স সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স’ (গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র)। সেখানে তিনি উচ্চতর গবেষণার ছাত্রদের সহায়তার পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন শুরু করলেন, যেখানে যোগ দিয়েছেন নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিদগ্ধজনেরা। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ কীর্তিমান এই মানুষটির মৃত্যূর পর হতভাগা এই দেশে সম্ভাবনাময় সেই প্রতিষ্ঠানটিও আর যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
এক সময় পুরো বিশ্বই হয়তো তোঁকে জানবে ‘বাংলার বিস্ময়’ হিসেবে, কিন্তু তাতে আমাদের ভূমিকাই বা কতোটুকু?