নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ‘সামরিক ক্যু’র ওজর তুলে বিভিন্ন কারাগারে কি পরিমাণ মানুষ হত্যা করা হয়েছে তা খুঁজে বের করার জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এই আহ্বান জানান। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি আমাদের সংসদ সদস্যদের একটা উদ্যোগ নেয়া উচিত, জিয়ার আমলে প্রত্যেকটা কারাগারে কত মানুষকে ফাঁসি দিয়ে মারা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা এবং কুমিল্লায়। একটার পর একটা ক্যু আর শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেগুলো একটু খুঁজে বের করে দেখেন।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর কত শত সৈনিক-কর্মকর্তা এবং মানুষকে সে সময় হত্যা করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলোতো (রেকর্ড) থেকে যায় সেগুলো একটু খুঁজে বের করে দেখেন। একেক রাতে ফাঁসি দিতে দিতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল, এখনও এরকম লোক আছে।
তিনি বিএনপি’র প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এদের কাছ থেকে মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়। এদের কাছে জ্ঞানের কথা, আইনের শাসনের কথা শুনতে হয়। অথচ আমি আমার বাবা-মা হত্যার জন্য মামলা করতে পারিনি। আমার কোন অধিকার ছিল না।
তাঁর নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব এবং বাংলাদেশকে নিয়ে জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন নেই স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করবো। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারে আসলে জনগণের কল্যাণ হয়। সেই কল্যাণই হবে।
তিনি এ সময় কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে সকলের টিকার ব্যবস্থা করতে যত টিকা লাগে তাঁর ব্যবস্থা সরকার করবে উল্লেখ করে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা পুণরায় স্মরণ করিয়ে দেন।
জিয়া যে ’৭৫ এর জাতির পিতার হত্যার সঙ্গে জড়িত সেই অভিযোগ পুনরায় উত্থাপন করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, সে ’৭৫ এর হতাকাণ্ডের সঙ্গে যে জড়িত এতে কোন সন্দেহ নেই। আমি তাকে আসামি করতে চেয়েছিলাম। তখন আমাদের হোম সেক্রেটারি ছিল রেজাউল হায়াত, সে বলল মৃত মানুষকেতো আসামি করা যায় না। কিন্তু আমার মনে হয় নামটা থাকা উচিত ছিলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর জিয়া যে ষড়যন্ত্রে জড়িত তাতো ফারুক- রশিদ নিজেরাই বলেছে বিবিসি’র ইন্টারভিউতে। এ্যন্থনী ম্যাসকারহানস-এর বইতে আছে, লরেন্স লিফশুলজ এর বইতে আছে।
কিভাবে অস্বীকার করবে। আর তাই যদি না করে তাহলে স্বাধীনতার পর যে যুদ্ধাপরাদীদের বিচার হয়েছিল তাদের সে ছেড়ে দিল কেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের ৭ খুনের আসামিকেও মুক্ত করে দিলো। এমন বহু ঘটনা সে ঘটিয়েছে। জিয়া সেই সব খুনিদের নিয়েই পরে দল করলো।
তিনি বলেন, যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে এক হয়ে এদেশে অগ্নিসংযোগ হত্যা, খুন ধর্ষণ করেছে তাদেরকে মন্ত্রী, উপদেষ্টা করে সংসদে বসালো। জাতির পিতার খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করলো আর তার থেকে একধাপ উপরে গিয়ে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া কর্নেল রশিদ এবং হুদাকে এমপি বানিয়ে সংসদে বসালো। এইতো তাদের চরিত্র। যে খুনি, সন্ত্রাসি, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধী, ধর্ষণকারী এদেরকে নিয়েই তাদের চলাফেরা। গোলাম আজম পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে চলে গিয়েছিলো। জিয়াউর রহমাান তাকে ফেরত নিয়ে আসলো। আর বহুদলীয় গণতন্ত্র, জিয়ার নির্বাচন, ’৭৭ এর হ্যাঁ, না ভোট, ’৭৯ এর নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচিত্রা তখন সরকারি পত্রিকা সেখানে উঠলো আওয়ামী লীগ ৪০টি সীট পাবে। অথচ তখন দল বলতে বাংলাদেশে একটাই ছিল আওয়ামী লীগ।
মানুষের ভোট ধ্বংস করে ভোটের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্টটা জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশে করেছে। ব্যাংকের থেকে টাকা নিয়ে লোন শোধ না করার কালচার তার শুরু করা। মানুষকে দুর্ণীতিবাজ করা। মেধাবী ছাত্রদের এতহাতে পুরস্কার দিয়েছে অন্যহাতে তাদের অস্ত্র, অর্থ তুলে দিয়ে বিপথে পাঠিয়েছে।
জিয়া আসলে বহুদলীয় নয়, দেশে কারফিউ গণতন্ত্র দিয়েছে বলেন, প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে জিয়ার কবর (সংসদের সীমানায় থাকা) নিয়ে কথা উঠেছে। জিয়ার মৃত্যু সংবাদের পর তার লাশ পাওয়া যায়নি। গায়েবানা জানাযা হয়েছিলো। আর কয়েকদিন পরে একটা বাক্স আনা হলো।
তিনি জেনারেল এরশাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, কারো পরামর্শে এটি করা হয়। সাজিয়ে গুছিয়ে একটা বাক্স নিয়ে এসে দেখানো হলো। তখন এই সংসদে বার বার প্রশ্ন এসেছে। যদি লাশ পাওয়া যায় তবে লাশের ছবি থাকবে না কেন? প্রধানমন্ত্রী বলেন, মীর শওকত (মীর শওকত আলী বীরউত্তম) সেই লাশ সনাক্ত করেন।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে চেনার কারণে প্রধানমন্ত্রী একদিন তাকে যে প্রশ্ন করেন তার উদ্ধৃতি তুলে ধরেন তিনি।
‘সত্যি কথা বলেন তো, সে বলেছিলো লাশ কোথায় পাব।’ এমনকি জেনারেল এরশাদকে বারবার এবং মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি জিগ্যেস করেছিলেন, ‘আপনি যে একটা বাক্স নিয়ে আসলেন লাশটা কোথায় পেলেন।’
এরশাদ বলেন, ‘বোন লাশ পাব কোথায়?’ আর কি বলবো। কাজেই আজকে যে কথাটা উঠেছে তখন সেটা আমরা বার বার জানতে চেয়েছি এবং তখন যে বিএনপি’র নেতারা ছিলো তারা কি করে গেছে সেটা আপনারাই দেখেন।
বিএনপি’র সাংসদ রুমিন ফারহানার বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত পোষণ করে বলেন, ইতিহাস ফিরে আসে। জাতির পিতার একদিন নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিলম ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হয়েছিল এমনকি ৭ মার্চের ভাষণটি পর্যন্ত এদেশে বাজাতে দেয়া হোত না। তিনি বলেন, ২৫ মার্চ যখন সারাদেশে রাস্তায় বেরিকেড দেয়া হচ্ছিল চট্টগ্রামেও বেরিকেড দেয়া হচ্ছিল। জিয়াউর রহমান তখন পাকিস্তানী সেনাদের হয়ে বেরিকেড দানকারিদের ওপর গুলি চালিয়েছিলো। এরপর সে গেল সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে। সেখানে পাবলিক ঘেরাও দিয়ে তাকে তাকে আটকাল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার যে স্বাধীনতার ঘোষণা সেটা তৎকালিন ইপিআর ওয়্যারলেস এবং পুলিশ স্টেশনের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে গেল। যে সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়েছিল সেই নেতারা সেটা সংগ্রহ করে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিল। জিয়াউর রহমান যে চট্টগ্রাম কান্টনমেন্টে ছিল সেখানে কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। যে কারণে সবথেকে বেশি মানুষ মারা গেছে সেখানে। এখনও ভাটিয়ারিতে সেই গণকবর রয়ে গেছে। সে যদি সঠিক সিদ্ধান্ত দিত আমাদের সোলজাররা সেটার ব্যবস্থা নিতে পারতো। কিন্তু সেটা সে করে নাই। যেটা অন্যেরা করেছিলো। জিয়াউর রহমান করে নাই।
সরকার প্রধান বলেন, ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমান কেবল স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেছিলো। আর এই সংসদে যখন প্রশ্ন উঠলো স্বাধীনতা দিবস ২৬ তারিখ আর জিয়া ঘোষণা দিয়েছে ২৭ তারিখ তখন ইতিহাস বিকৃতিকারিরা সেই ২৭ তারিখকে ২৬ তারিখ বানিয়ে ফেললো। অথচ ২৬ তারিখ তখন জিয়াউর রহমান পকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলো।
যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এই দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সব ব্যবস্থা করে দেশ স্বাধীন করেছেন সেখানে একজন মেজরের কথায় সবাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো আর দেশ স্বাধীন করে ফেলল তাও কখনো হয়। আর বঙ্গবন্ধুই জিয়াকে প্রশোশন দিয়ে যে মেজর জেনারেল করেছিলেন, দেশ স্বাধীন না হলে জিয়া কখনো তা হতে পারতেন না, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়ার মা-বাবা পাকিস্তানে মাইগ্রেট করে এবং জিয়া সেখানেই আর্মিতে ঢোকে। তার পোস্টিং হয় আমাদের বাংলাদেশে।
‘হাড়িভাঙ্গা আম’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানোর জন্য বিএনপি’র সমালোচনার উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেখুন আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। তিনি বলেন, আমি কেবল পাকিস্তান নয় আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সব দেশেই এই আম পাঠিয়েছি। কারণ আমাদের আম অত্যন্ত সুস্বাদু। একটা হচ্ছে বন্ধুত্বের নিদর্শন। আরেকটা হচ্ছে আমার এই উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ, এটা বাস্তবকথা। দুইদিকেই আমাকে দেখতে হবে এবং আম কিন্তু সবাইকেই পাঠিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনারা আমাদের ওপর যে অত্যাচার করেছে সেটা নিশ্চই আমরা ভুলতে পারি না। সেটা ভুলে গিয়েছিলো বিএনপি।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু তাকে খেতাব দিয়েছে সবই সত্যি। কিন্তু আদতে মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানটা কি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কর্নেল আসলাম বেগ, জিয়াউর রহমানকে চিঠি দেয় এবং যে চিঠিও তাঁর কাছে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া যেখানকার দায়িত্বে ছিলো সেখানেই সব থেকে বেশি মানুষ মারা গেছে, ক্যাজুয়ালিটি বেশি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে সে তখন যুদ্ধে কি কাজ করেছে, পাকিস্তানীদের পক্ষে যাতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুবরণ করে সেই ব্যবস্থা করেছিলো কি না। সেটাই আমার প্রশ্ন।
তিনি বলেন, জিয়াতো একটা সেক্টরের অধিনায়ক। সেক্টর কমান্ডার ছিলো জিয়া।
শেখ হাসিনা বলেন, কর্নেল আসলাম বেগ তখন ঢাকায় দায়িত্বরত ছিলো পরে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হয়েছিলো। সেই কর্নেল আসলাম বেগ জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ’৭১ সালে একটা চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে সে লিখেছিলো ‘আপনি খুব ভালো কাজ করছেন। আমরা আপনার কাজে সন্তুষ্ট। আপনার স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনাকে ভবিষ্যতে আরও কাজ দেয়া হবে।’ এই চিঠি অতীতেও সংসদে পড়া হয়েছে তারপরেও তিনি সংসদে এনে উপস্থাপন করবেন যাতে সংসদীয় প্রসিডিংস এর এটা একটা অংশ হয়ে থাকে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সংসদ নেতা প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন একটা সেক্টরের অধিনায়ক হয়ে সেখানকার ক্যাজুয়ালিটি বাড়িয়ে দেয়ার মানে কি? সে নিজের হাতে পাকিস্তানী সেনাদের গুলি করতে যায়নি বরং আমাদের নিজেদের লোকদের এগিয়ে দিয়েছে মরতে। এ বিষয়টি মেজর হাফিজের বইতেও রয়েছে পরে যে বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে, বলেন তিনি।
সান নিউজ/এফএআর