নিজস্ব প্রতিবেদক: না ফেরার দেশে চলে গেলেন সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি তাড়াশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী ম ম আমজাদ হোসেন মিলন।
রোববার (১৮ এপ্রিল) বেলা সাড়ে এগারোটায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মৃত্যৃকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। প্রবীণ এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে তাড়াশ-রায়গঞ্জ তথা চলনবিল এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন প্রমুখ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী ম ম আমজাদ হোসেন মিলন ১৯৪৯ইং সালে ১১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী চলনবিল অধ্যুষিত মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের মাগুড়াবিনোদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃত কবি ম ম আব্দুর রহমান বিনোদী, মাতার নাম মৃত অছিরন নেছা।
গাজী আমজাদ হোসেন মিলন তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নররত অবস্থায় রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভবে জড়িয়েয়ে পড়েন ষাটের দশকে।। ১৯৬৯ সালে তাড়াশ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় পাকিস্তান স্বৈরশাসকের শোষণ-নিপীড়ণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নিজ এলাকায় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পানিঘাটা ক্যাম্প (৭নং সেক্টরের অধীনে) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা, গোলাবারুদ ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্রসহ বাংলদেশে প্রবেশ করে আব্দুল লতিফ মির্জা পরিচালিত পলাশডঙ্গা যুব শিবিরে যোগদান এবং ৬০০ জন মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত ঐ ক্যাম্পে সহ-সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রনাঙ্গণে কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করে এবং উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ তাড়াশের নওগাঁয় ১১ই নভেম্বর সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে ১৫০জন পাকহানাদার বাহিনী সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয় এবং ক্যাপ্টেন সেলিম সহ ৯জন পাক আর্মিকে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করেন। সেই সাথে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর নিকট সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজ মাঠে আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে হস্তান্তর করা হয়। এরপর নাটোর জেলাধীন গুরুদাসপুর কলেজে থেকে এইচএসসি কৃতিত্বের সহিত পাশ করেন আমজাদ হোসেন মিলন। এরপর জনগনের পুনর্বাসনের কাজে নিয়োজিত হওয়ায় তার লেখাপড়া আর সম্ভব হয় নাই।
মাত্র ৮ মাসের নববধু শ্বশুর বাড়ি রেখেই ভারতে চলে যান। বৃদ্ধ বাবা ও মা এলাকা ছেড়ে অন্য থানায় আত্মীয় বাড়িতে আতঙ্কে ও কষ্টের সহিত জীবন যাপন করেন। তাদের বাসার সাথেই তার মামাতো ভাই মাহতাব উদ্দিনকে মিলনের যুদ্ধে যাবার কারণে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তার লাশ পাওয়া যায়নি এবং রাজাকাররা মিলনের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতাত্তোর কালে তাড়াশ উপজেলার ৪নং মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়ন পরিষদে দুই-দুইবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন (একবার বিনা প্রতিদ্বন্দিতায়) তিনি। পরবর্তীকালে সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি থানার সমবায়ীদের প্রত্যক্ষ ভোটে সিরাজগঞ্জ সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন থেকেই সুদীর্ঘ ১৮ বছর তাড়াশ থানা আওয়ামী লীগের পর্যায়ক্রমে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন । এ কারণে শাসকগৌষ্ঠির রোষানলে পড়ে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে। ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তাড়াশ উপজেলা পরিষদের বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালে পুনরায় তাড়াশ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময় রাজশাহী বিভাগীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের একবার কৃষি বিষয়ক সম্পাদক, আরেকবার ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে এবং তিনবার বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তাড়াশ উপজেলা কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হত্যার একদিন পরেই মিলনের বাড়ীতে পুলিশ হানা দেয়। তাকে না পেয়ে তার বৃদ্ধ পিতাকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন করে। একদিন পরে ছেড়ে দেয়। মিলন তিন মাস পালিয়ে বেড়ানোর পর আটক হন। তাকে অমানষিক নির্যাতন করে এমন কি লোহার রড পুড়িয়ে তার শরীরে ছেকা দেয়।
সাননিউজ/টিএস/