তারেক সালমান: সরকারপন্থী, সরকার বিরোধী নানা নামের নানান সংখ্যার নামসর্বস্ব রাজনৈতিক জোট দেশে বিরাজমান থাকলেও রাজনীতির মাঠে নেই কোনো জোট।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল, রাজনীতির মাঠে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দল ছাড়াও বাম সংগঠনগুলোরও রয়েছে বেশ কয়েকটি জোট। যদিও এসব জোটের মধ্যে বেশিরভাগই সংখ্যাতাত্ত্বিক জোট। প্রকৃত পক্ষে এসব জোটে কোনটিতে নামের চেয়ে সংখ্যাই বেশি বা কম রাজনৈতিক দল এসব জোটের শরিক। যেমন ক্ষমতাসীন দলের নাম ১৪ দলীয় জোট হলেও ওই জোটে প্রকৃত পক্ষে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের সংখ্যা মোট ১৩টি। অপরদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নাম ২০ দলীয় জোট হলেও প্রকৃত পক্ষে সেখানে রয়েছে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কমপক্ষে ২৪টি।
এসব জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নামকাওয়াস্তে জোট শরিক থাকলেও প্রকৃত পক্ষে কোনো জোটই রাজনীতির মাঠে সক্রিয় নেই। নেতাদের মনে প্রশ্ন রাজনীতির জোট শরীক থাকলেও প্রকৃত পক্ষে রাজনীতি কোথায়? মাঠের রাজনীতিতে নেই কোনো জোটই। ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের নেতাদের অনেকে বলছেন, এ জোট কেবলই কি ক্ষমতার সাধ আস্বাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কী লাভ হলো এ জোট করে? জোটের কাজ কী, জোটের রাজনীতিই বা কী; সেই বিষয়ই অনেকে বুঝতে পারছেন না।
কিছুদিন আগে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাসের সঞ্চালনায় ভার্চুয়ালি একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।এসময় বক্তারা জোটের কর্মকান্ড জোরদারের দাবি জানান।
সভায় সমাজতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান বলেন, ভাষা পেয়েছি, তারপথ ধরে স্বাধীনতাও পেয়েছি। কিন্তু সামগ্রিক মুক্তি পাইনি আমরা। তিনি বলেন, ১৪ দল মাঝে মাঝে সরব হলেও নীরব থাকে বেশিরভাগ সময়। অনেকবার বিষয়টি ১৪ দল নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময় বললেও কার্যকর হয়নি।জোটের অভ্যন্তরীণ দলগুলো কীভাবে চলছে, বার বার জানালেও কোনো ফলাফল আসেনি।
জোট শরিক এক বামনেতা বলেন, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল ও জোট দেশ-বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।এগুলো করতে তারা সুযোগ পাচ্ছে আমাদের নিজেদের অনেকের কাজের কারণে। ক্ষমতায় থেকে ফুলে ফেঁপে প্রাচুর্যে অনেকে দেশের বাইরে অর্থপাচার করছেন।এগুলো দেখে জামায়াত জোট আরও শক্তিশালী বিরোধিতা করছে।তিনি আরও বলেন, আমি ও আমার দল সকল সংগ্রামে ছিলাম-থাকবো।তবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের শতভাগ বাস্তবায়ন চাই।১৪ দলের মধ্যে বঞ্চিত দল ও নেতৃবৃন্দের টিকে থাকার নির্দেশনা চাই।
অপরদিকে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে হঠাৎ করেই ‘ব্যর্থ রাজনীতিক’ হিসেবে পরিচিত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গজিয়ে উঠে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। রাজনীতিতে প্রায় জনবিচ্ছিন্ন ড. কামাল হোসেনকে ‘প্রধান নেতা’মেনে ওই ফ্রন্টে যোগ দেয় বিএনপি, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য। সঙ্গে কামাল হোসেনের গণফোরাম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে গণস্বাস্থ্যর প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ও ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশনের মালিক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ আরও অনেকে।
জামায়াতে ইসলামী এই ফ্রন্টে প্রকাশ্যে না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে ঐক্যফ্রন্টের হয়ে নির্বাচন করে।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি নতুন স্বপ্ন দেখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’গঠন করা হলেও নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসে সেই স্বপ্নেরও অপমৃত্যু হতে থাকে। কিন্তু তখন ফ্রন্টের শরিক নেতাদের আর কিছু করারও ছিল না। ছিল না সময়ও। সেই কারণে দাঁত কামড়ে অনেকেই জোটে থেকে যান। এমনকি নির্বাচনের পরও অনেকেই এ জোটকে চাঙা করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সরব থাকার পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু শীর্ষ নেতার ‘রহস্যজনক নিরবতা’ও বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির সঠিক সিদ্ধান্তহীনতা ও নেতৃত্ব গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে জোটটিকে আর কার্যকর করা যায়নি বলে শরিকদের অভিযোগ।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সাননিউজকে বলেন, যেভাবেই দেখি বা বলি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সোজা কথায় বলতে গেলে, ফ্রন্ট এখন অকার্যকর।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, আমাদের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি আছে, নানা কারণে এটা হয়েছে। নির্বাচনের পর আমাদের বসা উচিত ছিল।আরও আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল। আলাপ-আলোচনা যে হয়নি, তা কিন্তু নয়। তবে এটা ঠিক বৃহত্তর স্বার্থেই আমরা শপথ নিয়েছি। আর দলের সিদ্ধান্তেই আমি শপথ নেইনি।কেউ কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু বিকল্প কী ছিল আমাদের হাতে? শপথ না নিলে সরকার আরও ফাঁকা মাঠে গোল দিতো। আমাদের কিছুই করার থাকত না।
তবে ‘ঐক্যফ্রন্ট অকার্যকর’বিষয়টি মানতে নারাজ জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি সাননিউজকে বলেন, ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য থাকবে।প্রয়োজনে এই জোটের পরিধি আরও বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কারারুদ্ধ সব নেতা-কর্মীর মুক্তি ও জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে লড়াই করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
রব বলেন, আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকার ও ওয়াদাবদ্ধ। ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে জাতির কাছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও আইনের শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতিতে আমরা নির্বাচনে গিয়েছিলাম। এটা আমরা এখনও আদায় করতে পারি নাই। আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন ও ঐক্য অব্যাহত থাকবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কার্যকারিতা আছে কি-না জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান সাননিউজকে বলেন, জোটে থাকা না থাকা নিয়ে সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য দেবেন আমাদের দলের (বিএনপি) মুখপাত্র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত- এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বলুন বা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোট সব জোটই আসলে ‘অকার্যকর’। জোট না থাকাই ভালো।
এই মুহূর্তে শুধু বিএনপিই নয়, সকল রাজনৈতিক দলের উচিত নিজেদের ঘর গোছানো। নিজেদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা।কারণ জগদ্দল পাথরের মতো দেশের ঘাড়ের ওপর যে সরকার চেপে বসে আছে, গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা ফেরাতে হলে সেই সরকারকে হটাতে হবে।এর কোনো বিকল্প নেই। তাই আমি মনে করি, এ মুহূর্তে কোনও ধরনের জোটের প্রয়োজনীয়তাও নেই।যখন সবাই নিজেদের গুছিয়ে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হবে তখন সব রাজনৈতিক দল এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ‘যুগপদ’ আন্দোলন করবে; কোনও জোটগতভাবে নয়।
অ্যাডভোকেট আজম আরও বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বলুন বা ২০দলীয় জোট বলুন আসলে কোনোটারই প্রয়োজন নেই। জোটের কারণে আসলে দলেরই ক্ষতি হয়। নির্বাচন আসলে জোটভুক্ত নামকাওয়াস্তে দল যার মাঠে কোনও ভোট নেই, সেই সব দলকেও জোটগত কারণে আসন ছেড়ে দিতে হয়। সেক্ষেত্রে নিজেদের অনেক যোগ্য প্রার্থী, নেতাদের কোরবানি করতে হয়। তাতে শুধু ওই নেতাই ক্ষতিগ্রস্ত হন না ক্ষতি হয় দলের। কারণ দীর্ঘদিন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে একজন নেতা তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে ভোটের সময় ভোটবিহীন ও সাংগঠনিক কোনও ভিত্তি নেই এমন দল ও নেতাকে আসন ছেড়ে দিলে সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের ওপর অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যা দলকে অনেক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সান নিউজ/টিএস/আরআই