নিজস্ব প্রতিবেদক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক, স্বৈরাচার পতন সংগ্রামের অগ্রনায়ক, ক্রান্তিকালের কাণ্ডারী, বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মরহুম এ বর্ষীয়ান নেতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি ও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন স্মৃতি ফাউন্ডেশন দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।
মানিকগঞ্জের ঘিওর থানায় বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের মরহুমের গ্রামের বাড়ি পাঁচুরিয়া জামে মসজিদে এ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এছাড়া, বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় (নীচ তলা), নয়াপল্টনে বাদ যোহর মিলাদ ও দোয়া মাহফিল করবে বিএনপি।
এদিকে, দলের সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আগামী ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার বিকাল ৩ টায় দোয়া মাহফিল ও স্মরণ সভা করবে বিএনপি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হল (৩য় তলা) এ স্মরণসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিশেষ অতিথি থাকবেন জাতীয় স্থায়ী কমিটি সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদিন ফারুক, যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। এতে সভাপতিত্ব করবেন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন পেশায় আইনজীবী ছিলেন। মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার খিরাই পাচুরিয়া গ্রামে ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। তার পিতা খোন্দকার আবদুল হামিদ ছিলেন একজন মশহুর আলেম এবং মাতা ছিলেন আকতারা খাতুন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৪৭ সালে মানিকগঞ্জ হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৪৯ সালে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স), ১৯৫৩ সালে এমএ এবং ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে খোন্দকার দেলোয়ার বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীর সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি মানিকগঞ্জ মহকুমা আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
দেলোয়ার হোসেন ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং তখন থেকেই তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলের (কপ) প্রাথী ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে মানিকগঞ্জ মহকুমায় গঠিত ইলেকশন মনিটরিং কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির মানিকগঞ্জ মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। আইনজীবী সমিতিগুলোর কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি ১৯৭০ সালে ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পরপরই মানিকগঞ্জে গঠিত বিপ্লবী কম্যান্ড কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে গঠিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন এবং দলের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক নিযুক্ত হন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার পর তিনি মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে পুনরায় তিনি বিএনপির মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১ (ঘিওর-দৌলতপুর) নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকা থেকে পঞ্চম (১৯৯১), ষষ্ঠ (১৯৯৬), সপ্তম (১৯৯৬) ও অষ্টম (২০০১) সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন সংসদীয় দলের চীফ হুইপ এবং সপ্তম জাতীয় সংসদে বিরোধী সংসদীয় দলের চীফ হুইপ ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাবের সভাপতি এবং বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্য ছিলেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বেশসংখ্যক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৭৬-১৯৭৮ এবং ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং ১৯৭৯-১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জ খোন্দকার নূরুল হোসেন ল’ একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ। তিনি তাঁর নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন কলেজ এবং পাচুড়িয়া মাদ্রাসা। ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে।
আশির দশকের শেষদিকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী আন্দোলনে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় মোর্চার লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তত্বাবধায়ক সরকার কৃর্তক ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারীর পর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার প্রাক্কালে তিনি দলের মহাসচিব আব্দল মান্নান ভূইয়াকে বহিস্কার করে খোন্দকার দেলোয়ারকে দলের মহাসচিব পদে নিয়োগ দান করেন। এক-এগারোর পর যখন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা আটক ছিলেন, তখন খোন্দকার দেলোয়ার অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সঙ্কটের মোকাবেলা করে দলের ঐক্য ও অখন্ডতা অক্ষুন্ন রাখেন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর পুনরায় তিনি বিএনপির মহাসচিব নিযুক্ত হন।
খোন্দকার দেলোয়ার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জাতীয় স্বার্থে পালিত তার সংগ্রামী ভূমিকার জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতা দখলকারী সেনাসমর্থিত সরকারের দিনগুলোতে তার ভূমিকার কথা স্মরণ করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্বারের সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন এক দুর্দান্ত সাহসী নেতা। সেটা এমন এক সময় ছিল ওই সরকার যখন দুই নেত্রীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার এবং রাজনীতিকদের উৎখাত করার ভয়ঙ্কর চেষ্টা চালাচ্ছিল। সরকার একদিকে দলীয় নেতাদের গ্রেফতার করেছিল, অন্যদিকে দলের ভেতর থেকে কোনো কোনো নেতা গোপনে সরকারকে সহযোগিতা দেয়ায় সে সময় বিশেষ করে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল। তেমন এক কঠিন সময়ে নিজে গ্রেফতার বরণ করার ঠিক আগমুহুর্তে খোন্দকার দেলোয়ারকে বিএনপির মহাসচিব পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। দলের জন্য তো বটেই, এই সিদ্বান্ত দেশ ও জাতির জন্যও অত্যন্ত সঠিক এবং সুফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে। মামলা ও গ্রেফতারের হুমকি এবং দমন-পীড়নের ভয়-ভীতি দেখানোসহ সব পন্থাতেই তাকে বাগে আনার চেষ্টা পালিয়ে দেখেছে সরকার। কিন্তু মাথা নোয়ানো দূরে থাক, খোন্দকার দেলোয়ার এমনকি সামান্য নমনীয়তাও দেখাননি। বস্তুত তার এই ভূমিকার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি টের পাননি, নেত্রীর অভাব পর্যন্ত বোধ করেননি। দলীয় সভা-সমাবেশের পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন ও টিভির টকশোতে তিনি দুর্দান্ত সাহস বক্তব্য রেখেছেন, সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং জাতীয় নির্বাচন দেয়ার দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ যথার্থই বলেছেন, খোন্দকার দেলোয়ার ছিলেন রাজনীতির দুঃসময়ের কান্ডারি। বলা বাহুল্য, গভীর দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন মনোভাব ছিল বলেই খোন্দকার দেলোয়ারের পক্ষে অমন অনমনীয় অবস্থান নেয়া এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়েছিল। একই কারণে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারসহ রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিপক্ষরা পর্যন্ত তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মনে-প্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। নিজে বিএনপি করলেও অন্য দলগুলোর প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ছিল পরমতসহিষ্ণুতা। প্রতিপক্ষের কঠোর সমালোচনা করতেন তিনি, কিন্তু বিদ্বেষ বা শত্রুতা নয়, সবকিছুর পেছনে থাকত কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে কখনও একচুল পরিমাণ ছাড় দেননি তিনি। নিখাদ ছিল তার দেশপ্রেম।
ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকার জন্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন একুশে পদকে ভূষিত হন। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ১৬ই মার্চ তার মৃত্যু হয়।
সাননিউজ/টিএস/এসএম