নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘একাত্তরের ৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সরকারের হয়ে গুলি চালিয়েছিলেন’, প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, আজকে একটি পত্রিকায় ছাপিয়েছে ৯ মার্চে ১৯৭১ সালে মওলানা ভাসানী পল্টনে ময়দানে কী বললেন? তিনি বললেন, স্বাধীনতা মেনে নিন-ইয়াহিয়াকে ভাসানী। আর কাল বিলম্ব না করে স্বাধীনতা দিয়ে দিন। একদিনে, একজনের ভাষণে স্বাধীনতা আসেনি-এই কথাটাই আমরা বার বার বলতে চেয়েছি। আমাদের সেই বক্তব্যের পরে সরকার প্রধান ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক কথা বলেছেন যেটা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।
সোমবার মঙ্গলবার বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর এক আলোচনা সভায় তিনি এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিএনপির স্বাধীনতা সূবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ঐতিহাসিক ৯ মার্চ উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কেনো এই মিথ্যাচার? এর কারণটা কী? একটাই কারণ এখানে শুধুমাত্র তাদের যে লক্ষ্য সেই লক্ষ্যকে চরিতার্থ করতে চায়, তাদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে, একজন মাত্র ব্যক্তি তার একক ঘোষণায়, তার একক কথায় দেশ মুহুর্তের মধ্যে স্বাধীন হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, নয় মাস কী কষ্ট করে, লড়াই করে যুদ্ধ করেছে, এককোটির উপরে মানুষ শরনার্থী হয়ে ভারতে চলে গেছে বাড়িঘর ছেড়ে সব কিছু। এখানে যারা ছিলেন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর কথা চিন্তা করেছেন, তুলে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি বাহিনীরা, ফিরে আসেনি। এখানে কত মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন-সেসব কথা উচ্চারণ কিন্তু হয়না। তাদের কথা কেউ বলে না।
ফখরুল বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তিনি যদি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিতেন তাহলে কি যুদ্ধ শুরু হতো? হতো না। উনার স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এবং যুদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘উই রিভোল্ট’ এই কথা মধ্য দিয়ে এবং প্রবাসী সরকার গঠন হওয়ার অনেক আগেই হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়াতে জিয়াউর রহমান সাহেব, আমাদের এমএজি ওসমানীসহ সেক্টার কমান্ডাররা সবাই বসে বৈঠক করে ন্যাশনাল কমান্ড ফর লিবারেশন ওয়ার তারা তৈরি করে ফেলেছেন। সেটা ৪ঠা এপ্রিল।
তিনি বলেন, ওখানে (তেলিয়াপাড়া) গেলে আপনারা সেই প্ল্যাট দেখতে পারবেন। আপনাদের প্রত্যেকের উচিত সেটা দেখা। আমাদের সেনা নায়করা যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন তারা কিভাবে একত্রিত হয়ে বসে তাদের কর্মসূচি প্রস্তুত করেছেন এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই ঘোষণা করেছেন।
১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানি শাসকদের মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার আগে মওলানা ভাসানীই প্রকাশ্যে স্বাধীনতার কথা সমস্বরে উচ্চারণ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি ইংগিত করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে কোনো একজন বললেন যে, ২৫/২৬ মার্চ ….। এটা হাস্যকর, এটা হাস্যকর ছাড়া কিছু নয়। এটা কেউ বিশ্বাস করবেন না এজন্যে যে, দেখা যায় যে, উনি এমন সমস্ত কথা বলেন, যার ঐতিহাসিক প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেন না।
আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা কোনো নেতাকে ছোট করার জন্য নয় বা কাউকে বড় করার জন্য নয়। আমরা আমাদের স্বাধীনতাতে যার যার যে অবদান আছে, সেই অবদানকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই। আজকে সেজন্যে আপনাদের (ক্ষমতাসীন সরকার) শরীরে গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। আপনারা বিভিন্ন রকমের অসংলগ্ন কথা-বার্তা বলছেন, অপ্রকৃতিস্থ কথা-বার্তা বলছেন যেগুলোর সঙ্গে সত্যের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। সত্য একটাই এদেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষ তারা পূর্ব পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন, যুদ্ধ করেছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের যুদ্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
আওয়ামী লীগের অবদানের কথা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, অবশ্যই আপনাদের অবদান আছে। অবশ্যই বিরাট বিরাট অবদান আছে। ১৯৭১ সালের আপনাদের যে অবদান সেই অবদান কেউ কোনোদিন আমরা অস্বীকার করি না। একই সঙ্গে আপনারা যখন মূল নায়কের অবদানটাকে অস্বীকার করেন সেটাকেও আমরা কোনো মতেই মেনে নিতে পারি না। আমি আগেও বলেছি, শহীদ জিয়ার খেতাব তুলে নেবেন। নিক। কে খেতাব পেলো কি পেলো না, তাতে কিছু আসে যায় না শহীদ জিয়ার। তিনি এদেশের মানুষের অন্তরে রয়েছেন।
ফখরুল বলেন, এই সরকার একটা গণবিরোধী সরকার। তারা ইতিহাসকে বিকৃত করছে। এই সরকার গণমানুষের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন করে এদেশকে একটা স্বৈরাতান্ত্রিক দেশে পরিণত করেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে জনগনকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান বিএনপি মহাসচিব।
মওলানা আবদুল আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বের প্রশংসা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তিনি একজন কিংবদন্তির নায়ক। উনার নামের মধ্যে ম্যাজিক্যাল বিষয় রয়েছে। তিনি আসামের নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে বিশেষ করে বাঙালি কৃষকদের পক্ষে আন্দোলন করতে ছুটে বেড়াতেন পুরো আসাম। সেই সময়ে আসামের ভাসানচরে চর আছে সেখানে তিনি ঘোড়া নিয়ে যেতেন। মানুষ দেখতো ভাসানী এই এখন এখানে, আবার ৫০ মাইল দূরে আরেক জায়গায়। সেই অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিয়ে তিনি মানুষকে সংঘবদ্ধ করছেন, জমিদারদের বিরুদ্ধে মানুষকে সংঘবদ্ধ করছেন। সেই থেকে ভাসানচর থেকে তার নাম হয়েছে ভাসানী।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, তিনি পাকিস্তানিদের বৃটিশদের হাত থেকে বের হওয়ার জন্য, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন-সংগ্রাম করেছেন। আজীবন সংগ্রামী, আজীবন খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কথা বলেছেন, লড়াই করেছেন। এই সারা সময়টা জুড়ে এবং তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার আগে কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আপনারা যদি কখনো টাঙ্গাইলে যান সন্তোষে। গিয়ে দেখবেন যে, এখন তো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। তার পাশে ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর আছে। সেই খানে ভাসানী থাকতেন।
স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে বিএনপির জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা ৭ মার্চ পালন করেছি। আওয়ামী লীগের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের পরে ততকালীন নেতা তিনি নিজেও ৩২ নং বাড়িতে যখন সাংবাদিকরা উনাকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলো তিনি বলেছিলেন, আমি ইমানসিপেশনের কথা বলেছি, মুক্তির কথা বলেছি। আমি কোনো রকমে প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেন্ডেসের ঘোষণা দেয়নি, স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।
তিনি বলেন, অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনিও আমাদের ৭ মার্চ পালন করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। তাহলে এটা কী হয়? আমরা অ্যাকশনে গেয়েছি, তারা রি-অ্যাকশন দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন সেদিন। সেদিন সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের একটি সরকারি প্রোগ্রামে তিনি বললেন, ৭ মার্চের ঘোষণাই স্বাধীনতার ঘোষণা। আর গতকাল তিনি আরেকটি তথ্য দিয়েছেন যে, জিয়াউর রহমান ২৫ ও ২৬ মার্চ মানুষ হত্যা করেছে। ইতিহাস যে কি পরিমানে বিকৃত বা নিজের খেয়াল মতো বলা যায়, সরকারে আছে যা ইচ্ছা বলা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমের লেখা ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে: মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধতি তুলে ধরে তিনি বলেন, যেখানে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একাত্তরের ২৫ মার্চ ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈনিকেরা এক হাজার বাঙ্গালীর হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা। গ্রন্থে লেখা আছে ওই সময়ে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ও ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) মেজর রফিকুল ইসলাম উভয়ের বিদ্রোহের প্রস্তুতির কাজটি করছিলেন। অথচ আজকের সব পত্রিকায় আছে প্রধানমন্ত্রী বলে দিলেন ২৫ ও ২৬ তারিখ জিয়াউর রহমান বাঙ্গালী হত্যা করেছে।
২৬ তারিখ সকালে তিনি ছিলেন পটিয়ার একটি পাহাড়ে ক্যাম্প করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করার জন্য। তারপরে কালিরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম তিনি নিজের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং ২৭ তারিখ সকালে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এটা তো ইতিহাস। জিয়েউর রহমান যদি জনগনের কাছে বন্দি থাকেন তাহলে এসব কাজ করলেন কি করে? আজকে দূঃখজনক ৫০ বছর পরে আমাদেরকে এই ধরনের (বিকৃত) ইতিহাস শুনতে হচ্ছে।
জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, স্বাধীনতা একদিনের কারো একক প্রচেষ্টায় আসেনি। তাই কেউ এককভাবে স্বাধীনতার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না। ৯ মার্চে পল্টন ময়দানের সমাবেশ থেকে ভাসানী ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই স্বাধীনতা কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা-কামার-কুমারসহ সকল বাঙালির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের ফসল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, একাত্তরের এই দিনে(৯ মার্চ) মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার জন্য পল্টন ময়দানে আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি জনসমক্ষে এভাবে স্বাধীনতার বিষয়টা তুলে ধরার প্রথম ব্যক্তি। ভাসানী ছিলেন আন্দোলনের জাদুঘর। ১৯৬৮ সালে তিনি তখনকার ১৯ টি জেলায় ডিসি অফিস ঘেরাও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন সেখানে আমিও ছিলাম।
জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আবদুস সালামের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও বক্তব্য রাখেন।
সান নিউজ/টিএস/আরআই