নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সাধারণ মানুষ যখন ভীত সন্ত্রস্ত, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পলায়নপর সেই সময় গোটা জাতিকে আশা যোগাবার জন্য কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সেই ঘোষণা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে। আশার সঞ্চার করেছে।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের এই স্বাধীনতার ঘোষণা, এই ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক মাইলফলক। বাঙালি জাতির হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন মেজর জিয়াউর রহমান এই ঘোষণার মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হওয়া এত সহজ না, শরণার্থী হওয়া সহজ। মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে কামান বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে হয়। মৃত্যুর সাথে প্রতিমুহূর্তে পাঞ্জা লড়তে হয়। একটা কালো কোর্ট গায়ে দিলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না।
রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপ্রদত্ত জিয়াউর রহমানের 'বীর উত্তম' খেতাব বাতিলের প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
মেজর হাফিজ বলেন, ১৫ ডিসেম্বর মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা সিলেট দখল করেছিলাম। সারাদিন যুদ্ধ হয়েছে। এর আগের তিনদিন আমরা অভুক্ত ছিলাম। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে চা বাগানের ভেতর দিয়ে যুদ্ধ করে করে মিত্র বাহিনীর আগেই আমরা সিলেট শহর দখল করার গৌরব অর্জন করতে চেয়েছিলাম। সিলেট থেকে ৮মাইল দূরে খাদিম নগরে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ান ১৫০০ সৈনিকের বাহিনী নিয়ে সিলেট এমসি কলেজে প্রবেশ করি। সেখানে ১৪-১৫ ডিসেম্বর দুদিনব্যাপি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে আমার কোম্পানির ১৫জন সৈনিক শহীদ হয়। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাংলাদেশের ৫টি ক্যান্টনমেন্টে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা ও ইপিআর যদি বিদ্রোহ না করতো তাহলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হতো কিনা সন্দেহ আছে।
তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সম্মান করি। তারা নির্বাচনে জিতেছেন, তাদের সকল অধিকার রয়েছে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার। কিন্তু এই ধরণের ভয়াবহ বর্বর বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের কোনো উপায় ছিল না। বাংলাদেশের ৫টি ক্যান্টনমেন্টে যশোর, জয়দেবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সৈয়দপুর ও চট্টগ্রামে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫টি ব্যাটেলিয়ন অবস্থান করছিল। যখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আলোচনার ফাঁদে ফেলে পানি ও বিমান জাহাজে পাকিস্তান থেকে কামান গোলাবারুদ আনা হচ্ছিল। সেসময় আমাদের সৈনিকদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে। আমরা রাজনৈতিক নেতার নির্দেশের অপেক্ষা করেছিলাম, যেটি আমরা পাইনি। তারপর এই গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করার জন্য মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা, বর্বর দখলদার বাহিনীর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকেরা স্বাধীনতাযুদ্ধে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তার পুরষ্কার কী পেলাম, আজকে স্বাধীনতার ৫০বছর পর বলা হচ্ছে জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের চর। কেউ কেউ বলেন, তিনি রাজাকার ছিলেন।
মেজর হাফিজ বলেন, বাংলাদেশে রাজাকার শব্দটি অত্যন্ত ঘৃণিত। আর একটি শব্দ ইতোমধ্যে ঘৃণিত হয়ে গেছে, যার নাম জামুকা। এরা নব্য রাজাকারের দল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ কত ভয়াবহ, এই জামুকা-ফামুকা তা কল্পনাও করতে পারে না। এক কামানের মাঝারি মানের গোলা এখানে নিক্ষেপ করা হলে, পাশে প্রেসক্লাবের যে ভবন সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। এখানে একটি পুকুরের সৃষ্টি হবে। এই সব মেশিন গানের শব্দ, যুদ্ধ বিমানের শব্দ উপেক্ষা করে যুদ্ধ করতে হয়। জীবনের বিনিময়ে এই দেশ অর্জন করেছি। রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন শরণার্থী। তবু তাদের শ্রদ্ধা জানাতে চাই। তারা একটি সরকার গঠন করে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যারা জীবন দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করলো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করলো, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদেরকে কি সম্মান দেখাবেন না? এইটুকু কি আমরা আশা করতে পারি না?
তিনি বলেন, আজকে এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা একত্র হয়েছেন। আজকে দেশের নেত্রী কারাগারে। দেশে গণতন্ত্র নাই। কিন্তু রাজপথে কার্যকরভাবে নেমেছে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা দল। এই যে বিশাল ছাত্রদল, যুবদল, বিএনপি। দুদিন পরে যারা মন্ত্রী হবেন। তারা অনেক কিছু পাবে। কিন্তু এই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা কি পাবেন? কিন্তু দেশের টানে মাতৃভূমির টানে এখনো যে তারা রাজপথে নামেন; আমি তাদের অভিবাদন জানাই, গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
বিএনপির সিনিয়র নেতা মেজর হাফিজ আরও বলেন, গতকালও একজন মন্ত্রী বললেন, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার তথ্য প্রমাণ নাকি তাদের কাছে আছে। ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৬টার সময় আমি তৎকালীন উপ-প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম ৩২ নম্বরের ওপরে আক্রমন চালানো হয়েছে। আপাদমস্তক সৈনিক জিয়াউর রহমান বলেছেন, 'সো হোয়াট? প্রেসিডেন্ট ইজ কিল্ড, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। প্রেসিডেন্ট নেই তো কি হয়েছে, উপ-রাষ্ট্রপতি আছে। আমরা সৈনিক, আমরা সংবিধানকে সমুন্নত রাখবো'। আমি এবং সাফায়েত জামিল স্বাক্ষী। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু বইয়ে লিখে গেছেন। আমি লেখক নই, তাও একটা বই লিখেছি আমার জীবনের ঘটনা নিয়ে। সেখানে এই ঘটনা লেখা আছে। তিনি (জিয়া) সৈনিক, আপাদমস্তক সৈনিক ছিলেন, কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিলেন না।
তিনি বলেন, আরও একটি কাহিনী অবতারণা করা হয়েছে। কর্নেল ফারুক, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। সে নাকি কোনো সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে আমরা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। জিয়াউর রহমান বলেছেন, আমি সিনিয়র অফিসার, আমি এসবের মধ্যে নাই, তোমরা পারলে করো। এটা সর্বৈব একটি মিথ্যা কথা। এই সেই কর্নেল ফারুক, ৭৭সালে লিবিয়া থেকে এসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। তিনি গোপনে এসে বগুড়া ক্যান্টমেন্টে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, ঢাকায় জিয়াউর রহমানের সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছেন। জিয়াউর রহমান দক্ষ সেনানায়ক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, জনগণের প্রিয় একজন রাষ্ট্রপতি। তিনি কঠোর হস্তে ফারুককে দমন করেছেন এবং বিমানে করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফারুকের সঙ্গে যদি আতাত থাকতো, তাহলে কেন ফারুক, ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করতে এসেছিল? এগুলো কোনো কল্পকথা নয়, বাস্তবতা। বাংলাদেশের সব মানুষ জীবিত, ১৯৭৭সাল সেদিনের কথা। মিথ্যাকে সত্য করার জন্য এই সরকার একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বুনেই চলেছে। আমরা শুধু দেখেই যাচ্ছি।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। যারা ছিল রাজাকার, তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ বানানো হয়েছে। যুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার, এখন হয়েছে আড়াই লাখ। কারা এগুলো বৃদ্ধি করে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৬ জন সচিব ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থাৎ এই সরকারের কাজই হলো দলীয় লোকজনকে মুক্তিযুদ্ধের লেবাস পরিয়ে দেয়া। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া এতো সহজ না, শরণার্থী হওয়া সহজ। মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে কামান বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে হয়। মৃত্যুর সাথে প্রতিমুহূর্তে পাঞ্জা লড়তে হয়। একটা কালো কোর্ট গায়ে দিলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না।
হাফিজ বলেন, কষ্ট হয় এই বাংলাদেশ দেখলে। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা লড়াই করেছিলাম, সেই গণতন্ত্র আজ দেশ থেকে বিলীন হয়ে গেছে। বাক স্বাধীনতা নাই। ৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছিল, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। আবারও সময় এসেছে। আবারও স্লোগান ধরতে হবে-বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জিয়াউর রহমানসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানাতে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সরকারের উদ্দেশ্যে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বর্তমান সরকার যদিও নির্বাচিত না তবুও তাদের অনুরোধ করবো, এই ধরণের ঘৃণ্য উদ্যোগ গ্রহণ করে জিয়াউর রহমানের মতো সেরা মুক্তিযোদ্ধার খেতাবকে টানাটানি করে নিজেরা নব্য-রাজাকারে পরিণত হবেন না। জনগণ আপনাদের ঘৃণার চোখে দেখবে। আজ থেকে ১০০ বছর পরে কে দেখবে, কে 'জামুক' কে কি ছিল। কিন্তু তখন জিয়াউর রহমান এবং উপস্থিত এসব মুক্তিযোদ্ধাদের নাম শ্রদ্ধা সাথে স্মরণ করবে। আমরা যারা যুদ্ধ করেছিলাম, আমাদের সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ, এই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের যে লুটেরা, ব্যাংক চোর, দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের হাত থেকে মুক্ত করে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েল, গণফোরাম নেতা মোস্তাক হোসেন।
সান নিউজ/টিএস/এসএস