তারেক সালমান ও মাহমুদুল আলম: উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে চান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু তার এ চাওয়া একমাত্র বাস্তবায়ন হতে পারে সরকারের মানবিক সিদ্ধান্তের ওপর। তার স্বজন ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
কেমন আছেন দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের মেজোবোন বেগম সেলিমা ইসলাম সাননিউজকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি নেই। সব কিছু আগের মতই আছে। কারও সাহায্য ছাড়া নিজের কোনো কাজ নিজে করতে পারেন না তিনি। নতুন করে কোমড় এবং পায়ের ব্যথা বেড়ে গেছে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছিলেন রোদে বসতে। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে ছাদে যেতে পারেন না তিনি। ছাদ ছাড়া তার ভাড়া বাসা ফিরোজায় রোদ আসে না। আর কতকাল এভাবে থাকবেন তিনি? মুক্তি পেলে উন্নত চিকিৎসা নিতে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারতেন।
সেলিমা ইসলাম আরও বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে সরকারের কাছে আবেদন দেয়া আছে। এই নিয়ে এখন আর আমার সাথে কেউ আলাপ করেনি। করোনা সংকটের কারণেও তিনি এতদিন উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেননি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনই পছন্দ বিএনপি চেয়ারপারসনের। সর্বশেষ তিনি লন্ডনেই চিকিৎসা নিয়েছিলেন। চোখের অপারেশন করিয়েছেন। এখনও লন্ডনের চিকিৎসকদেরই নিয়মিত ফলোআপে আছেন তিনি। শারীরিক অবস্থার বিবেচনায় বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দিতে সরকারের কাছে পারিবারের পক্ষ থেকে আবেদন জমা দেয়া আছে। সরকারের পক্ষ থেকে ‘গ্রীন সিগনাল’ পেলে বাকী সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে।
স্বজনরা জানান, সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে। এখন বিদেশ যাত্রায় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে কবে নাগাদ খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দেয়া যাবে তা নির্ভর করছে সরকারের ‘মানবিক’সিদ্ধান্তের ওপর।
এদিকে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বর্তমানে আইনত কী সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন বা পারেন না, কতটা পাচ্ছেন বা পাচ্ছেন না- এই বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন সাননিউজ কে বলেন, ‘এটা আমাকে জিজ্ঞাসা না করে আমাদের মহাসচিব আছেন, তার কাছে জিজ্ঞাসা করুন।‘ কিন্তু আইনি ব্যাপারগুলো তো আপনারা ভালো বলতে পারবেন-বললে এই আইনজীবী বলেন, ‘আমি এখন এগুলো দেখছি না। উনি তো প্যারোলে আছেন, প্যারোলে তো না, স্পেশালি তাকে রাখা হয়েছে।‘
‘স্পেশালি রাখা’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেশের সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, ‘না, আমি এই ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেব না।‘ কিন্তু আইনি বিষয়গুলো তো মহাসচিবের চেয়ে আপনারা ভালো জানবেন-বললে তিনি বলেন, ‘না, না, এটা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, অথবা অন্য যারা আছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করেন।‘ কিন্তু উনার মামলা তো আপনিও ডিল করেন, আপনি আছেন তো উনার মামলায়, নাকি?- এই প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘অবশ্যই আছি। এখন মামলাই তো নাই বলতে গেলে। উনি এখন সরকারের ইসে আছে, তার বিরুদ্ধে মামলা তো এখন সব স্থগিত অবস্থাতে আছে।‘
উনি তো (খালেদা জিয়া) প্যারোলে আছেন, তাই না?–জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘না, সরকারের বিশেষ ক্ষমতায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আমার আগের স্টেটমেন্টগুলো দেখেন। এখন সে আসামি হিসেবেই আছে।‘- বলেন খন্দকার মাহবুব।
আগে স্টেটমেন্ট দিলেও খালেদা জিয়া এতদিন বাহিরে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওইভাবেই আছে। একজন আসামি হিসেবে, যা যা প্রাপ্য তাই পায়। ধরে নেন এখন উনি জেলেই আছেন। সরকার বিশেষ ক্ষমতায় তাকে জেলে থেকে বাহিরে রেখেছে। একজন আসামি জেলখানায় থাকলে যা যা করতে পারে, উনিও তার বেশি কিছু করতে পারবেন না।‘ ‘উনিও একই সুবিধা পাবেন।‘
জেলে থাকা আসামিদের সঙ্গে তার আইনজীবী দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার আইনজীবী বা নেতাকর্মীরা দেখা সাক্ষাৎ করতে পারেন কিনা? তাছাড়া সুযোগ সুবিধা ‘পাবেন’ বলছেন, পাচ্ছেন কিনা-তা জানতে চাইলে আইনজীবী বলেন, ‘চাইলে পাবেন।‘ ‘কিন্তু যেহেতু করোনাকাল, তাই তিনি কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন না।‘
প্যারোলে থাকলে কী পারবে, কী পারবে না, জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান সাননিউজকে বলেন, ‘না, না, না, আমি এটা বলবো না। এটা যারা তার (খালেদা জিয়া) কেস ডিল করেন, তাদেরকে বলেন। আমি তার কেস ডিল করি না। আমার দূর্ভাগ্য। আমি ম্যাডামের কেস ডিল করি না। যারা তার কেস ডিল করেন, তাদের সঙ্গে দয়া করে কথা বলুন।‘
বিএনপি চেয়ারপারসনের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির সাননিউজকে জানান, ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আসলে আমরা তেমন কিছু বলতে পারি না। কারণ আমরাতো ওনার কাছে যেতে পারি না। চিকিৎসকরা ওনাকে দেখতে যান। তারা (চিকিৎসক) জানান যে, ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা আসলে ভাল নেই।
চিকিৎসকদের বাইরে খালেদা জিয়ার স্বজনরা তাকে দেখতে মাঝে মাঝে ফিরোজায় যান জানিয়ে শায়রুল আরও বলেন, ওনার পরিবারের কেউ আসলে তারা তো যানই। এর বাইরে ওনার স্বজনরা যেমন ম্যাডামের মেজবোন সেলিমা ইসলাম, দুই ভাইয়ের স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ অন্য স্বজনরা তাকে দেখতে যান। এছাড়া দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত কয়েকজন সহকারীদের সঙ্গেই বেশিরভাগ সময় কাটে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর।
এর আগেও খালেদা জিয়া লন্ডন, সৌদি আরব এবং সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ১৫ জুলাই লন্ডন সফর করেন খালেদা জিয়া। সে সময় তার পায়ের ও চোখের চিকিৎসা হয়। তিনি লন্ডনেই চোখের অপারেশন করিয়েছিলেন। অস্টিও আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন খালেদা জিয়া। তার মেরুদন্ড, বাম হাত ও ঘাড়ের দিকে শক্ত হয়ে যায়। দুই হাঁটু প্রতিস্থাপন করা আছে। তিনি ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান। বাম চোখেও সমস্যা রয়েছে তার।
দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দির পর দীর্ঘ কারাভোগের পর গত বছর ২৫ মার্চে করোনা মহামারিতে শর্ত সাপেক্ষে খালেদা জিয়া মুক্তি পান। বিএনপি প্রধানের মুক্তির পর এক দফা সময় বাড়ানো হয়। আগামী ২৫ মার্চ এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ৭৬ বছর বসয়ী খালেদা জিয়ার বার্ধ্যকজনিত নানা রোগ ব্যাধি শরীরে দেখা দিয়েছে। ডায়াবেটিসসহ মাঝে মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে। ফলে তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন বাসায় বসে চিকিৎসায় এখন খুব একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, গত ২৫ জানুয়ারি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুবাষির্কীতে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হন। খালেদা জিয়া পরিবারিক আবহে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মুক্তির পর থেকে খালেদা জিয়া অবশ্য কিছুটা পারিবারিক আবহ মাঝে মাঝে পেয়ে থাকেন। তিনি পরিবারের সদস্য এবং ব্যক্তি চিকিৎসক ছাড়া কারও সাথে দেখা করেন না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকবার দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন সাননিউজকে বলেন, ম্যাডামের হাত, পা এবং কোমরের ব্যথা আগের চেয়ে বেড়েছে। যেহেতু ঠান্ডা একটু বেশি। সে কারণে ব্যাথাটাও একটু বেশি। মাঝে মধ্যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
তিনি বলেন, ডায়াবেটিকসের জন্য শুধু ওষুধ খেলে হবে না। ফিজিক্যাল ওয়ার্ক দরকার আছে। যেহেতু তিনি হাঁটতে পারেন না। সে কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। জয়েন্টের ব্যথাও বেড়েছে। এছাড়া শারীরিক অবস্থার উন্নিতর বলার মত কিছু নেই।
উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া মুক্তির পর থেকে গুলশানে ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’তে আছেন। বাসায় থেকেই তিনি আপাতত চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসায় মূল দায়িত্বে আছেন লন্ডনে অবস্থানরত পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান। তার পরামর্শেই মূলত খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে। এছাড়া খালেদা জিয়ার চিকিৎসক ডা. এ জে এম জাহিদ হোসেন এবং ডা. মামুন নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছেন। ডা. মামুন প্রায় প্রতিদিনই তার শরীরিক অবস্থা জানতে বাসায় যান। মাঝে মধ্যে ডা. জাহিদ হোসেনও বাসায় যান।
সাননিউজ/টিএস/এমএ/বিএস