মোহাম্মদ রুবেল : বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটিতে কোন মধু-সন্ধানে বয়স উত্তীর্ণরা। এছাড়া বিবাহিতসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও। স্থবির হয়ে পড়া ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি দীর্ঘ ১৬ মাস অপেক্ষার পর ৬৮টি শূণ্যপদ পূরণ হলেও এ কমিটি এখন অভিযুক্তদের ঠাই হওয়ায় নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
এনিয়ে খোদ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গুলোর নেতাদের মুখে মুখে এখন নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিভিন্ন ছাত্রনেতাদের মুখেমুখে রব উঠেছে ছাত্রলীগে কি মধু আছে? যেখানে থাকার কথা তরতরে ছাত্র যুবকের।সেখানে এখন বয়োবৃদ্ধরা।
এনিয়ে বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সাননিউজের সাথে কথা হয় সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আব্দুল্লাহ বিন মুন্সি। তিনি বলেন, শুধু কেবল বয়স উত্তীর্ণরাই নয়,ঠাই হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত,মামলার আসামি, চাঁদাবাজ, মাদকসেবী, সভাপতির মোটরসাইকেল চালিয়ে নেতা হওয়াসহ ছাত্রদল থেকে আগতদের স্থান দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সদ্য ঘোষিত কমিটিতে ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক পদ পেয়েছেন ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনির সেই বয়স পেরিয়ে গেছে ৫ বছর আগে। এ হিসেবে তার বয়স ৩৩। অথছ শোভন-রাব্বানী ছাত্রলীগের দায়িত্বে থাকা কালীন সময়ে তাকে দপ্তর সম্পাদক করতে চেয়ে ছিল,কিন্তু তার বয়স বেশি হওয়ায় তখন তাকে পদ দেওয়া হয়নি। কিন্তু বর্তমান কমিটিতে পেয়ে গেছেন পদ।
আরেকজন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি হয়েছেন দেবাশীষ সিদ্ধার্থ।তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকীর স্বাক্ষর জাল করে ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুই ছাত্র ভর্তি করাতে গিয়ে ধরা পড়ার অভিযোগ আছে। সেসময় তিনি ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের ছাত্র ও স্কুলবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। পরে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলাও রয়েছে। এক মামলায় তিনি প্রায় ৬ মাস জেলও খেটেছেন অথচ তাকে ফের ছাত্রলীগের সহসভাপতি করা হয়েছে।
এদিকে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে পরিচিত লাভ করেন আমানুল্লাহ আমান। কেন্দ্রীয় গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক উপসম্পাদক হয়েছেন তিনি। অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচিতে দেখা না গেলেও একসময়ে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান জয়ের ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল চালকের ভূমিকায় তাকে বরাবরই দেখা গেছে।
উল্লেখ্য,ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫-এর ক উপধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ২৮ বছর বয়সি বাংলাদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃত যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারেন। অথচ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নতুন কমিটিতে ঠাই হয়েছ ৩৩ বছরের কথিত ছাত্রদেরও।
বিভিন্ন অভিযোগে ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া কয়েকজন নেতা জানান, নতুন করে যাদের পদায়ন করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকের বয়স বেশি, বিবাহিত, ছাত্রদল ও শিবিরের সঙ্গে জড়িত। যে অভিযোগে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এর চেয়ে গুরুতর অভিযোগ আছে সদস্য পদপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৩ নেতাকে কোনো কিছু না জানিয়ে, তাদের পদ থেকে সরিয়ে নতুনদের পদায়ন করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বারবার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করে সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি মেসেজ দিয়েও তাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করা যায়নি।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয়আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের সমন্বয় করছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, সাননিউজকে এবিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হানিফ এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পদপ্রাপ্ত নেতাদের মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, রাজনীতি করলে মামলা হতে পারে। এখানে বিষয়টা হলো, সে অপরাধ করেছি কি না?
নতুন পদপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে যারা বিবাহিতদের মধ্যে রয়েছে-উপগণশিক্ষা সম্পাদক ওয়াহিদ খান রাজ ও সহসভাপতি শাহরিয়ার সিদ্দিঈ শিশিম বিবাহিত।সহসভাপতি ইসরাত কাশফিয়া ইরা, জিয়ান আল রশিদ, সুরঞ্জন ঘোষ, কৃষি শিক্ষা সম্পাদক মাকসুদুর রহমান মিঠু, উপছাত্র বৃত্তি সম্পাদক ইউসুফ উদ্দিন খান, উপ-স্কুল ছাত্র সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকন। উপমানব সম্পদ সম্পাদক বেলাল হোসেন মুন্না বিবাহিত ও ব্যবসায়ী।
অভিযোগ রয়েছে, শূন্যপদে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসভাপতি হয়েছেন রাকিবুল হাসান নোবেল। তার বিরুদ্ধে সরাসরি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছাত্রদল করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি দল পরিবর্তন করে ছাত্রলীগ শুরু করেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির উপপ্রচার সম্পাদক হয়েছেন ফেরদৌস মাহমুদ পলাশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। সে সংক্রান্ত অনেক প্রমাণ রয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে। এসব অভিযোগে শোভন-রাব্বানী দায়িত্বে থাকা সময়ে তাকে পদ দেয়নি। কিন্তু জয়-লেখক কমিটিতে তিনি পেয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক সম্পাদক।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়েছেন আরিফ হোসেন রিফাতের পরিবার আওয়ামী লীগ বিরোধী বলে অভিযোগ আছে। তার আপন চাচা জামালপুর জেলা সদর যুবদলের সভাপতি। একইভাবে উপ-আইন সম্পাদক করা হয়েছে শাহেদ খানকে। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত শাহেদের বিরুদ্ধেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের ক্যান্টিনে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানীর বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও বিক্রেতার অভিযোগ আছে।
সূত্রে জানা যায়, উপমানব সম্পদ সম্পাদক হিরণ ভূঁইয়া ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত ও অস্ত্র মামলার আসামি। সহসভাপতি আরিফুল ইসলাম আরিফ বয়স উত্তীর্ণ, সহসভাপতি খালিদ হাসান নয়ন মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন বিন সাত্তার বিবাহিত, উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক নাজমুস সাকিব বিবাহিত এবং সরকারি চাকরিজীবী; উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক সৌরভ নাথের (আসল নাম সৌরভ সাহা) বিরুদ্ধে চাঁজাবাজির মামলা রয়েছে। উপপাঠাগার সম্পাদক আতিকুল ইসলাম ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রদলের সঙ্গে তার ছবিও রয়েছে কমিটির নেতাদের কাছে।
আরও অভিযুক্তরা হলেন: সহসভাপতি সাগর হোসেন সোহাগ, রানা হামিদ, আনন্দ সাহা পার্থ, শুভ্রদেব হালদার, জিয়াসমিন শান্তা, শাহরিয়ার সিদ্দিকী শিশিম, মিজানুর রহমান পিকুল, রাকিবুল হাসান নোবেল, মো. মহিন উদ্দিন।
উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক শাহেদ খান, উপ-গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ওয়াহিদ খান রাজ, উপস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সম্পাদক রাজেশ বৈশ্য, সহসম্পাদক মীর সাব্বির, উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আমানুল্লাহ আমান, সদস্যপদে সাজিদ আহমেদ দীপ্ত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক সম্পাদক পদে আল-আমিন রহমান, উপতথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. আবদুর রশিদ (রাফি)। এদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদকাসক্ত, বিবাহিত, চাকরিজীবী, মামলার আসামি, বয়স উত্তীর্ণ, জাসদের পদধারী, ছাত্রদল করার অভিযোগসহ বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে।
উল্লেখ্য,ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগে পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের আগেই ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাদের অব্যাহতির পর সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান যথাক্রমে আল নাহিয়ান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। তিন মাস ভারপ্রাপ্ত থাকার পর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের ভারমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সান নিউজ/এমআর/এম