নিজস্ব প্রতিবেদক : বর্তমান সরকার শুরু থেকেই ‘কোভিড ১৯’ পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলেছে মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, করোনা ট্রেস-টেস্ট-ট্রিটমেন্ট নিয়ে কেলেঙ্কারির পর এবার করোনা নিয়ে নানা তেলেসমাতির কারণে টিকা গ্রহণের ব্যাপারেও মানুষের মনে সংশয় রয়েছে। অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। সরকার আগে জনগণকে টিকা দিতে চায়। এতে করে গণমানুষের মনে সন্দেহ ঢুকেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রচলিত রেওয়াজ হচ্ছে, যখন কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং সেবা দেয়া হয় শুরুতেই তা ক্ষমতাসীন ও সরকার সমর্থক প্রভাবশালী লোকজন ভোগ করে থাকে। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি, নেতা, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীর উচ্চ পর্যায়ের লোকজন সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও সেবা সর্বপ্রথম ভোগ করে থাকে।
প্রয়োজনে অন্যায় করে, জোর করে এমনকি লুট করে হলেও। কিন্তু করোনার টিকার বেলায় ভিন্ন ব্যবস্থার কথা সরকারি দলের মন্ত্রীদের মুখে শোনা যাচ্ছে। তারা যখন বলেন, করোনার টিকা সরকারী মন্ত্রী, এমপিরা আগে পাবেন এমন ব্যবস্থা করা হয়নি তখন দেশের মানুষ কনফিউজড হয়ে পড়ে।
সরকারের প্রতি আস্থার অভাবের কারণেই মানুষ চিন্তিত হয় পড়ে। বিশেষ করে কোন কোন মন্ত্রী যখন বলেন, বিএনপি চাইলে করোনার টিকা তাদেরকে সবার আগে দেয়া হবে, তখন এই টিকার প্রতি মানুষ গভীর ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়। টিকা প্রসঙ্গে সরকারি মন্ত্রীদের বক্তব্য সতীনের ছেলে কে বাঘ মারতে পাঠানোর মতো।
শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) দুপুরে জুমার নামাজের আগে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োাজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদন তুলে ধরে রিজভী আহমেদ বলেন, ‘ভারত করোনা ভাইরাস ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশে পাঠিয়েছে’ অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে ভারত যদি দেখে এটা নিরাপদ তখন তারা ভারতের জনগণকে এই ভ্যাকসিন দেবে। উল্লেখ্য যে, ভারত নিজেরা এর পরীক্ষা শুরু করবে আগামী মার্চ থেকে। ওই টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ না হওয়া সত্ত্বেও ভারত সরকারের ছাড়পত্র পাওয়ায় বহু বিশেষজ্ঞ বিস্মিত। সুতরাং আমরা কি বিপজ্জনক গিনিপিগে পরিণত হয়েছি ভারতের টিকা পরীক্ষার।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতেই বৃহস্পতিবার ভারত সরকারের সৌজন্যে বাংলাদেশে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠানো হয়েছে। এ নিয়েও জনমনে রয়েছে গভীর সন্দেহ-সংশয়। এর কারণ নিশিরাতের সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নানারকম বক্তব্য-মন্তব্য। আমরা যতদুর জানি, এখন পর্যন্ত ভারত তাদের দেশে কোভিড-নাইন্টিন মোকাবেলায় দুই ধরণের টিকা অনুমোদন দিয়েছে। একটি হচ্ছে বৃটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকার মিলিত গবেষণায় তৈরি টিকা ‘কোভিশিল্ড’। অপরটি হচ্ছে ভারত-বায়াটেকের উদ্ভাবিত টিকা 'কোভ্যাক্সিন'।
‘কোভিশিল্ড’ এবং 'কোভ্যাক্সিন' এই দুইটাই উৎপাদন করছে ভারতের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পুণের সিরাম ইনস্টিটিউট। তবে ভারত সরকার বাংলাদেশে কোনটি পাঠিয়েছে ? কোভিশিল্ড' নাকি 'কোভ্যাক্সিন' ? ভারতে টিকা গ্রহণের পর চারদিনে মারা গেছে তিন জন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ছয় শত। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির চিকিৎসকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিতর্কিত কোভ্যাক্সিন টিকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন দেশটির চিকিৎসকদের বড় অংশ। তারা বলেছেন, ‘কোভ্যাক্সিন নিয়ে আমরা সন্দিহান ও সংশয়ী।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, স্বামী-স্ত্রীর কুটনৈতিক সম্পর্কের জের হিসেবে 'উপহারে'র নামে ২০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার পরও মানুষের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির আরেকটি কারণ হচ্ছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে ভারত সরকার যে দামে 'কোভিশিল্ড' কিনছে তার চেয়ে এক ডলার বেশি দামে তারা বিক্রি করছে বাংলাদেশের কাছে।
কেনার সময় প্রতিটি টিকায় বাংলাদেশকে এক ডলার করে বেশি দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা নেয়ার পর প্রথমে বাংলাদেশ চায় অগ্রিম নগদ টাকায় কেনা টিকার সরবরাহ। সেটি সরবরাহ না করে তড়িঘড়ি করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিনা পয়সায় ২০ লক্ষ ডোজ দিয়ে কি বোঝাতে চাইলেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সেরাম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে তিন কোটি টিকার জন্য বেক্সিমকোর চুক্তি হয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাসের শুরুতেই ৫০ লাখ ডোজ 'কোভিশিল্ড' টিকা পাবে বাংলাদেশ। টিকার জন্য অগ্রিম হিসেবে ৬শ কোটি টাকা সেরামের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়। এই খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই জানা যায়, সেরাম ইনস্টিটিউটের উপর 'টিকা রপ্তানি'র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত সরকার। এখন হঠাৎ করেই আবার জনগণ শুনতে পাচ্ছে, ২৫ কিংবা ২৬ জানুয়ারি নাকি বাংলাদেশের কেনা টিকা'র ৫০ লাখ ডোজ আসবে। 'ঘোড়ার আগে গাড়ি' চলার হেতু কি ? 'উপহারের’ আগে বেশি দামে বাংলাদেশের কেনা টিকা সরবরাহে কি ক্ষতি ছিল ? এখানেই তো মনে হয় শুভংকরের ফাঁকি। জনগণের টাকা অকাতরে পাচার হওয়া।
রিজভী বলেন, সাধারণ মানুষের আতঙ্ক কাটাতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারাই এগিয়ে এসে কোভিড ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন। আমেরিকায় প্রকাশ্যে করোনা টিকার ডোজ নিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গোটা বিষয়টি ক্যামেরাবন্দি করে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় সংবাদমাধ্যমে।
তাকে দেখে ভ্যাকসিন নিতে এগিয়ে এসেছেন তিন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন। প্রকাশ্যে টিকা নিয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সও এবং হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। প্রতিষেধক নিয়ে ব্রিটেনবাসীর সংশয় দূর করতে রাজপ্রাসাদে বসে টিকা নিয়ে নজির গড়েছেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। জনগণের সংশয় নিরসন ও উৎসাহী করতে চীনের তৈরি করোনা টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে বলেছেন, টিকা যে নিরাপদ এবং বৈধ, তা নিশ্চিত করতে আমিই প্রথম ডোজ নিলাম।’ কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী শেখ সাবাহ আল খালিদ আল সাবাহকে প্রথম ডোজ দিয়ে দেশটিতে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
রিজভী আহমেদ বলেন, আমি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আহবান জানাবো পৃথিবীর দেশে দেশে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা যেভাবে টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে মানুষকে আস্থা ও ভরসা দিচ্ছেন ও আশ্বস্ত করছেন আপনারাও সেই পথ অনুসরণ করুন। তাদের মতো আপনারাও সাহসী পদক্ষেপ নিন। আপনারা আগে টিকা নিলে জনগণ ভরসা পাবে। এ টিকা নিতে সাহস পাবে গোটা দেশবাসী। টিকা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা কাটাতে সহায়ক হবে। অনাগ্রহ কাটিয়ে দেশবাসীকে টিকায় আগ্রহী করে তুলবে।
সান নিউজ/টিএস/এম/