নিজস্ব প্রতিবেদক : বাঙালি জাতির ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তি তোফায়েল আহমেদের আজ বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) ৭৮তম জন্মদিন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণালী অধ্যায়ের অধিকারী আজন্ম সংগ্রামী ক্ষণজম্মা বীর বাঙালি ও ৬৯এর গণআন্দোলনের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য তোফায়েল আহমেদ। ছাত্র জীবন থেকেই ইতিহাসের পাতায় পরিপূর্ণ রয়েছে তার বীরত্বগাঁথা এবং শ্রেষ্টত্বের অবদান।
বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ১৯৪৩ সালের ২২ অক্টোবর প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভোলা জেলার কোড়ালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আজহার আলী ও মাতা ফাতেমা খানম । ১৯৬৪ সালে ভোলা শহরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের আলহাজ্ব মফিজুল হক তালুকদারের জ্যেষ্ঠ কন্যা আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে তারা এক কন্যা সন্তানের জনক-জননী। কন্যা তাসলিমা আহমেদ জামান পেশায় একজন মুন্নী চিকিৎসক এবং জামাতা তৌহিদুজ্জামান তুহিনও একজন খ্যাতনামা কার্ডিওলজিস্ট।
তোফায়েল আহমেদ ৬০ সালে ভোলা সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে বরিশাল ব্রজমোহন(বিএম) কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি পাস করেন যথাক্রমে ’৬২ ও ’৬৪ সালে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকাবিজ্ঞানে এমএসসি করেন। কলেজ জীবন থেকেই তিনি সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহন করেন। তিনি ব্রজমোহন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ক্রীড়া সম্পাদক ও কলেজের অশ্বিনী কুমার হলের সহ-সভাপতি(ভিপি) পদে নির্বাচিত হন ৬২ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) হল ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক, ৬৫ সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহসভাপতি ও ১৯৬৬-৬৭ সালে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
তোফায়েল আহমেদ ৬৭ থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি ছিলেন। সেসময় চলমান চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৬ দফার সঙ্গে ১১ দফা অন্তর্ভুক্ত করে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন। ৬৬ সালের ৮ মে থেকে ৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ মাস কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় তৃণমূল পর্যন্ত গণআন্দোলন গড়ে তোলেন।
৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সব রাজবন্দীকে মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভার সভাপতি হিসেবে ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ চিত্তে জাতির জনককে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে ৬৯ এর ২৫ মার্চের মধ্যে তথাকথিত প্রবল পরাক্রমশালী লৌহমানব স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে গৌরবের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল। ৬৯ সালে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৭০ এর জুনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
ছাত্র ও গণআন্দোলনে সফল নেতৃত্বের কল্যাণে হল ও ডাকসুর ভিপি থাকাকালে জাতির জনকের একান্ত সাহচর্যে আসেন। ৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভোলার দৌলতখান-তজুমদ্দিন-মনপুরা আসন থেকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও চারনেতার একজন হিসেবে মুজিব বাহিনীর বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা সমন্বয়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তোফায়েল আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন। ৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বহাল ছিলেন। ৭৫ এ দেশে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ঘোষণার পর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হন। ৭৫ এ দেশের সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ(বাকশাল) গঠিত হয়। বাকশালের যুব সংগঠন জাতীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন তোফায়েল আহমেদ।
৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ৭৩, ৮৬, ৯১, ৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনসহ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সর্বমোট ৮ বার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দু’বার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মিনিস্টারিয়েল কনফারেন্সে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল, কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি ও আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে যোগদান করে স্বল্পোন্নত দেশের মুখপাত্র ও সমন্বয়কের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন এবং বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশের পণ্য উন্নত দেশগুলোয় শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের অঙ্গীকার আদায় করেন।
সংগ্রামী জীবনে সততা, মেধা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও বাগ্মিতার ফলে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এখনও দেশপ্রেমের মন্ত্রে রাজনীতির অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন। ১/১১ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে স্ত্রী-কন্যাসহ মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছেন।
তোফায়েল আহমেদ ভোলার বাংলাবাজারে তার মায়ের নামে স্থাপন করেছেন ফাতেমা খানম কমপ্লেক্স, ফাতেমা খানম গার্লস হাইস্কুল, ফাতেমা খানম ডিগ্রি কলেজ, ফাতেমা খানম মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, ফাতেমা খানম শিশু পরিবার, ফাতেমা খানম জামে মসজিদ, ফাতেমা খানম বৃদ্ধাশ্রম,আজহার-ফাতেমা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
মহান এ নেতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে পৌছে দিতে এ কমপ্লেক্সে তিনি আরও প্রতিষ্ঠা করেছেন দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতা জাদুঘর। তিনি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড, ইয়েমেন, ইরাক, মিসর, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, অস্ট্রেলিয়া, বাহামা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, কাতারসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সফর করেছেন।
সান নিউজ/ এসকে