সৈয়দ জাফরান হোসেন নূর: “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কী ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কী ভুলিতে পারি”
বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত কালজয়ী এই গানের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাংলা ভাষা আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে আত্মবলিদান দেওয়া ভাষা শহীদদের স্মরণ করে থাকে।
রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি বছর ঘুরে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) মায়ের সম্মান ও আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে মাতৃভাষা বাংলার জন্য “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন বাঙলা মায়ের অকুতোভয় সাহসী ও শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। এদিকে মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে ঢাকার রাস্তায় তৎকালীন স্বৈরাচার পাকিস্তান সরকারের আত্মকেন্দ্রিক ও কাপুরুষোচিত হামলায় শহীদ হন রফিকউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম, আবুল বরকত ও শফিউর রহমান।
পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে হাজারো ঘটনা নিয়ে যুদ্ধ ও জীবন দেওয়ার ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু ভাষার জন্য প্রথম জীবন দেওয়ার ভিন্ন ইতিহাস শুধুমাত্র আমাদের বাঙালি জাতির। বাঙালির ইতিহাসে জীবন দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এক অনন্য হার না মানা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’।
তবে বিশ্বে ভাষার জন্য একমাত্র বাংলাদেশী বাঙালিরাই প্রাণ দিয়েছেন বিষয়টি এমন নয়। এর একাধিক ঘটনা খোদ ভারতেই রয়েছে।
১৯৪৭ সাল। দুটি পৃথক ভূখণ্ড, মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার। দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচিত হয়েছিল আন্দোলন। আর এই ভাষা আন্দোলনই স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হয়। অবশ্য ভাষা নিয়ে বিতর্ক এর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।
ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের “ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য” বইতে লিখেছেন, "প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ"।
বইটির বর্ণনা অনুযায়ী দেশভাগের আগে অর্থাৎ চল্লিশের দশকের শুরুতেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সাহিত্যিকরা। তৎকালীন বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বাংলা, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি এই চারটি ভাষার পক্ষ-বিপক্ষে বিভিন্ন মত ছিল।
১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদি পত্রিকায় লেখক সাংবাদিক আবদুল হক লিখেছিলেন, "উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরীর যোগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলা ভাষীই চাকুরীর অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন"।
তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তবুও জিন্নাহ তার অনমনীয় অবস্থানে থেকে ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা'। সমাবেশে উপস্থিত অনেকেই প্রতিবাদ করেন। এই ঘোষণাকে নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে বাঙালীর স্বপ্নভঙ্গের সূচনা বলা যেতে পারে।
১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি পূর্ব-বাংলার অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক সমাবেশে জিন্নাহ'র কথাই পুনরাবৃত্তি করলে শুরু হয় ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো। যা লঙ্ঘন করেই শহীদ দিবসের জন্ম হয়েছিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছেই শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষণ হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন সেবিষয়ে সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না। মাতৃভাষা নিয়ে এই আন্দোলনেই বীজ রোপন করা হয়েছিল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশী বাঙালিদের আত্মত্যাগের রক্তাক্ত ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৮৮ টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ।
ফজলে লোহানী তার একুশের কবিতায় লিখেছেন,
‘শহরে সেদিন মিছিল ছিল।
পৃথিবী সেদিন উল্টো ঘোরেনি; এগিয়ে গেছে।
সবাই শুনলোঃ খুন হয়ে গেছে, খুন হয়ে গেল।
মায়ের দু'চোখের দু'ফোটা পানি গড়িয়ে পড়েছে রমনার পথে।’
সেইদিনের ৫২’র মিছিলে বর্বর পাকিস্তানী পুলিশের গুলিতে বাংলা মায়ের সোনার ছেলেরা সত্যি খুন হয়েছিলেন।
ভাষার জন্য কী শুধুমাত্র আমরাই প্রাণ দিয়েছি? বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। কিন্তু আমাদের অনেকেরই অজানা ভারতের আসামে বাংলা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন কিছু মায়ের সন্তান।
১৯৬১ সালে ভারতের আসামে বরাক উপত্যকার (বরাক ভ্যালি) কাছাড় জেলার বাঙালি অধ্যুষিত শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির বাংলা ভাষাভাষীদের প্রাণের ভাষাকে বাদ দিয়ে শুধু অহমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা করে প্রাদেশিক সরকার।
বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শিলচরে গঠিত হয় ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’। নীলকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন, বিভূতিভূষণ চৌধুরীর নেতৃত্বে শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জে শুরু হয় বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে গণআন্দোলন।
১৮ মে পর্যন্ত বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি না দেওয়ায় ১৯ মে সকাল থেকে হরতাল শুরু হয়। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে প্রথমে লাঠিচার্জ ও পরে গুলি করে আধাসামরিক বাহিনী। মুহূর্তেই ১৫ বিক্ষোভকারী লুটিয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলেই ৯ জন মারা যান। পরদিন হাসপাতালে আরও দুজনের মৃত্যু হয়।
সেই ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন - কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তারিণী দেবনাথ, সুনীল সরকার ও সুকুমার পুরকায়স্থ। তাদের সেই আন্দোলন ও আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। ভাষা শহীদদের স্মরণে আসামে এখনও ১৯ মে ভাষা দিবস পালিত হয়।
ভাষার জন্য আত্মবলিদানকারী পট্রি শ্রীরামালুর নাম আমরা কজন জানি? আজও অমর একুশের চেতনায় মাতৃভাষার জন্য দুই বাংলার মানুষ বীরগাঁথা শহিদদের নামে উদ্দীপ্ত হন। অথচ খোদ ভারতেরই মহাত্মা গান্ধীর শিষ্য পট্রি শ্রীরামালুর নামে একজন ভাষা সৈনিক রয়েছেন।
আজকের বাংলা ভাষা বলতেই যেমন আমরা দুই বাংলার ভূগোলকে বুঝি। শ্রীরামালুর দাবিই ছিল নিজের ভাষার স্বাতন্ত্র, তেলেগু ভাষী মানুষের স্বতন্ত্র এক প্রদেশ।
ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে উঠুক পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ— এই দাবিতে ১৯৫২-র অক্টোবর মাসে অনশনে বসেন তিনি। ১৫ ডিসেম্বর অনশনের ৫৮ দিনের মাথায় প্রাণ দিলেন শ্রীরামালু। তাঁর মৃত্যুতে উত্তাল জনতার হরতালে স্তব্ধ হল পথঘাট। শ্রীরামালুর মৃত্যুর দু-দিন পর দিল্লির সরকার ভাষাভিত্তিক স্বতন্ত্র অন্ধ্রপ্রদেশ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন।
মাতৃভাষার জন্য ভারতে আত্মবলিদান দেওয়ার ঘটনা দুটি আমাদের অমর একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগের গৌরবগাঁথার সাথে একই সমান্তরালে অবস্থিত নয় কী? দিনশেষে একথা স্পষ্ট আত্মবলিদানের ঘটনা তিনটি মাতৃভাষার জন্য, মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার জন্য এবং মায়ের আত্মমর্যাদা ও সম্মান রক্ষার জন্য।
বিশ্বের সব ধর্মগ্রন্থই মা, মাতৃভাষা এবং দেশের সম্মানকে উচ্চ আসনে রেখেছে। এমনকি এ তিনটি বিষয়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও উৎসাহিত করেছে। শহিদদের আত্মবলিদানের কল্যাণে আমরা মাতৃভাষা বাংলা পেয়েছি, পেয়েছি স্বাধীন ভূ-খন্ড বাংলাদেশ। কিন্তু আজ প্রশ্ন জাগে শহিদদের চেতনায় আমরা পরিচালিত হচ্ছি নাকি তাদের রক্তের সাথে প্রতারণা করতেছি। না হলে দেশের প্রতিটি অংশে বিদেশী ভাষা বলিষ্ঠভাবে স্থান করে নিচ্ছে।
বিশেষ করে অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারগুলোতে মহোৎসবে চর্চা হচ্ছে বিদেশী ভাষা। শক্তিশালী ভিনদেশী অর্থনীতির কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে বিদেশী ভাষা। ফের দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছে বৈষম্য। অর্থের মোহে একশ্রেণির লোকের বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা চলে এসেছে।
এই লোভী চরিত্রহীনদের জন্যই মধ্যযুগের বিখ্যাত বাঙালি কবি আবদুল হাকিম নূরনামা কাব্যে লিখেছিলেন-
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সাথে মাতৃভাষা বাংলা যেন আজ দিবস এবং উৎসব কেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে। দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ দায় আমাদের, রাষ্ট্রের সবার। বায়ান্নর শহিদদের চেতনায় মাতৃভাষার সম্মানকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হলে অদূর ভবিষ্যতে শিখর থেকে শেকলে আটকে যেতে সময় লাগবে বলে মনে হয় না।
লেখক:
স্টাফ রিপোর্টার
দৈনিক আমার বাঙলা