শতরূপা দত্ত
প্রতিটি সূর্যোদয় মানুষের জীবনে নতুন দিন নিয়ে আসে, মনে আনে নতুন আশা। আর নুতন বছরের সূর্যোদয় মানে তো নতুন পরিকল্পনা, নতুন প্রত্যাশায় বুক বাঁধা, বিদায়ী বছরের অপ্রাপ্তি আর অনাকাঙ্খিত স্মৃতি ভুলে নতুন করে সাফল্য অর্জনের স্বপ্ন দেখা। নতুন বছরে নতুন স্বপ্নকে ধারণ করে সামনে এগিয়ে চলার প্রয়াস থাকে প্রত্যেকেরই।
কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখলেই তো হবে না, সে স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য চেষ্টাতেও নতুন জোর লাগাতে হবে। ভেবে দেখুন তো, ব্যক্তিগত জীবনে বিদায়ী বছরটিকে নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? না হয়ে থাকলে, কেন সন্তুষ্ট নন তার কারণে খুঁজে বের করুন, ভেবে দেখুন নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট হতে হলে পুরোনো বছরটিতে আপনার কী করা উচিৎ ছিল যেটা আপনি করেননি। তবে, মনে রাখতে হবে যে সময় চলে গেছে তা আর ফিরে আসবে না। তাই ভবিষ্যতে কী করলে আপনি আপনার স্বপ্নপূরণ করতে পারবেন সেটা নিয়ে ভাবুন। আজই ঠিক করে নিন, এই বছরটির শেষে আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান, আর সেজন্য আপনার করণীয় কী? নিজের জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করুন, নিজের একটা উইশ লিস্ট তৈরি করুন, তারপর ধীরে ধীরে সেগুলো পূরণের চেষ্টা করুন। সারা বছরে অন্তত একটি স্কিল শেখার চেষ্টা করুন- হতে পারে সেটা খুব ছোট কিছু, সাঁতার শেখা, গাড়ি চালানো শেখা, কম্পিউটারে কোনো নতুন সফটওয়্যার শেখা, গ্রাফিক্স ডিজাইনিং শেখা, ফটোগ্রাফি কোর্স করা, কেক বানানো বা রান্না শেখা। কারণ, প্রচলিত একটি কথাই আছে, ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’।
এতো গেল ব্যক্তিজীবনের কথা। দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আশা-নিরাশার দোলায় সময় পেরিয়ে যায়। এই যে সদ্য যে বছরটি ফেলে এলাম পেছনে, সেই বছরটিরও অনেক ব্যর্থতা ছিল, আবার ছিল অনেক সাফল্যও।
বাংলাদেশ বহুকাল বহির্বিশ্বে ছিল উপেক্ষিত ও অনালোচিত দেশ। বাংলাদেশের কথা উঠলেই ‘বটমলেস বাস্কেটের’ তুলনা টানা হতো। শেখ হাসিনা সরকার এই দুর্নামটি শুধু দূরই করেনি, অর্থনীতির উন্নয়নের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে সমালোচক দেশগুলোরও প্রশংসাও অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাংকও এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করে। এই দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বন্ধ হয়েছে, মৌলবাদী হিংস্রতা দমন হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একইসঙ্গে ভারত, চীন, আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব এখন স্বীকৃত। বিশ্বরাজনীতিতেও বাংলাদেশ একটি সম্মানজনক স্থান করে নিয়েছে। এই অর্জন তো একদিনে হয়নি। বহু বহু বছরের অনেক ব্যর্থতাকে পেছনের ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ই আজ বাংলাদেশকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
২০১৯ সালে অবকাঠামো উন্নয়নে দেশে বড় বড় কাজ হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলের মতো মেগা প্রজেক্টের কাজ এগিয়েছে দ্রুতগতিতে। রূপপুরে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণকারী দেশ থেকে বিনিয়োগের অনুকূল ভূমিতে পরিণত হয়ে বাংলাদেশ সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে এখন জিডিপি ৩১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ আগের দশকের তুলনায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
এসব উন্নয়নের পাশাপাশি আশাহত হওয়ার মতো কিছু দিকও ছিল গত বছরটিতে। ব্যাংকিং সেক্টরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে গত বছর। দুর্নীতির লাগাম এখনো শক্তভাবে টেনে ধরা যায়নি। নির্যাতনের মুখে জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন এখনো শুরু করা যায়নি। দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ঝুঁকি হিসেবে তারা রয়েই গেছে।
নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে গত বছরটি জুড়ে আলোচনায় ছিল আগুন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে প্রায় ২২ হাজার ৩৫৪টি, যা ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ সময় নিহত হয়েছেন প্রায় ১৮৭ জন, আর আহত প্রায় ৩৯১ জন। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০৫ কোটি টাকার। অগ্নিকাণ্ডের পেছনের কারণ হিসেবে বারবার উঠে এসেছে সচেতনতার অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ ভবন ব্যবস্থার কথা। গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বহুতল ভবন ও কারখানার প্রায় ৯০ শতাংশেরই অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার তথ্য। আগুন ঝুঁকিতে থাকা বাসভবন ও কারখানার তালিকা করা হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম এবং এর কর্মীরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা বেশ পুরনো। ২০১৯ সালে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২০১৮-র তুলনায় চার ধাপ নেমে ১৫০-এ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের অবনতি ঘটছে।
তবে, সূচকে অবনতি ঘটার বিষয়টি একবাক্যে মেনেও নেয়া যায় না। কারণ, এরমধ্যেও নতুন নতুন অনেক সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম এ দেশে আত্মপ্রকাশ করেছে বা করার পথে রয়েছে। একসময়কার শুধু সংবাদপত্রের উপর নির্ভরশীল সমাজ আজ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ ও বিনোদন খুঁজে নিচ্ছে। আর ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফলস্বরূপ অনলাইন সংবাদ মাধ্যম তো হয়ে উঠেছে নতুন বাস্তবতা। তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে আজ ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করেছে ‘সান নিউজ’ নামের এই অনলাইন সংবাদ মাধ্যমটিও। আশা করি, এই সংবাদ মাধ্যমটি গণমাধ্যমের যথাযথ ভূমিকা পালন করে সাহসের সাথে গণমানুষের কথা বলবে। এখানকার সাংবাদিকরা গণমানুষের হয়ে তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরবেন।
সামনের দিনগুলোতে সব অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে সবকিছু শুভ হয়ে উঠবে- নতুন বছরে নতুন সূর্যের আশাজাগানিয়া আলো যেন সে দ্যুতিই ছড়িয়ে দিচ্ছে।
স্বাগত ২০২০, স্বাগত নতুন সূর্য।
শতরূপা দত্ত: লেখক ও গণমাধ্যম কর্মী
সান নিউজ/সালি