সুলতানা আজীম
প্রথম যখন ইউরোপে এসেছি পাশ্চাত্য এ দুনিয়ার অনেক ব্যাপারই মুগ্ধ করেছিল আমাকে। এখনো করে। যে একটি বিষয়ের ধোঁয়াশা থেকে মুক্ত হতে সময় লেগেছিল একটু বেশী, তা হচ্ছে ইউরোপীয় নর-নারীর প্রেম। পেশাগত কারণে ইউরোপের প্রায় সব দেশের বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। সেটাও সাহায্য করেছে সেই ধোঁয়াশাকে অতিক্রম করতে।
অযৌক্তিক প্রথা থেকে অনেকাংশে মুক্ত এসব দেশে চার পাঁচ বছরের একটি শিশু যদি মা বাবাকে বলে, অমুকের সাথে আমার প্রেম হয়েছে, আমি তাকে ভালোবাসি, তাহলে মা-বাবা এ বিষয়ে জানতে চান। শিশুর প্রেমিক বা প্রেমিকাটির সম্পর্কে আগ্রহ দেখান। কখনো যদি শিশুটি তার প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে ঝগড়া করে এসে বলে, ওকে আমি আর ভালোবাসিনা, ওর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে, তাহলে মা খুব আদুরে গলায় জানতে চাইতে পারেন, ‘কেন ঝগড়া হলো, এখন কী হবে, কাকে ভালোবাসবে তুমি?’ কিছুদিন পরে শিশুটি যদি বলে, এখন আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি, তখনও মা বাবা, দাদু, নানুরা একই রকম ভাবে আগ্রহ দেখান এবং শিশুটি তার ভালোবাসার নতুন মানুষকে কিছু উপহার দিতে চাইলে, অবশ্যই তা কিনে দেন। এই প্রেম প্রেম খেলার ভেতর দিয়েই শিশুর বিকাশ ঘটতে থাকে, প্রেম উপলদ্ধির। অন্যান্য শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের মতোই। চতুর্থ শ্রেণী থেকে শুরু হয় প্রেম ও সেক্স বিষয়ে স্কুলগত শিক্ষা। নির্দিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এসব বিষয়ের ভালোমন্দের ওপর স্পষ্ট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও দেওয়া হয়।
শিশুবয়স থেকে টিনএজ পর্যন্ত যে প্রেম, তার সময় সীমা দীর্ঘ হয়না মোটেই। কিছুদিন আগে যে বালক বালিকাকে হাত ধরে হাটতে, চুমু খেতে দেখেছি, তাদেরই কাউকে যখন আবার একইভাবে অন্য জনের সাথে দেখতাম, তখন মনে হতো এসব কি সত্যিই প্রেম? এরকম বালক বালিকা, কিশোর কিশোরীদের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করে যা বুঝেছি, তার স্বাভাবিকতা না মেনে উপায় ছিলনা।
টিনএজ মার্লিনাকে প্রশ্ন করেছিলাম একদিন, ‘কিছু দিন আগে অলিভারের জন্য অস্থির থাকতে তুমি, আর এখন ভালোবাসো স্টিভেনকে। কি করে সম্ভব? ‘তখন ওটাই সত্যি ছিলো, এখন এটাই সত্যি। অলিভারের ভেতরের দিকটা যখন জেনেছি, তখন আর ভালো লাগেনি’ বলেছিলো মার্লিনা। ‘যদি স্টিভেনের সম্পর্কেও একদিন বিপরীত ধারণা বা অভিজ্ঞতা হয়, তবে কী ওকেও ছেড়ে দেবে?’ জানতে চেয়েছিলাম। ‘অবশ্যই’ স্পষ্ট জবাব ছিল মার্লিনার। এ বিষয়টি নিয়ে যতই ভেবেছি মনে হয়েছে, দু’জন নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসাতো মূলত ভালোলাগার দায়ে আবদ্ধ, অন্য কোনো দায় নেই এতে। ভালোলাগার পরিমান কমতে থাকলে, ভালোবাসার পরিমানতো অনন্ত অসীম হয়ে উঠতে পারেনা।
পৃথিবীর কোনো কিছুই যদি অবিনশ্বর না হয়, তো নরনারীর প্রেম-সম্পর্ক অবিনশ্বর হবে কেন? প্রেম নারী ও পুরুষের হৃদয়কে কিছুদিন একত্রে ধরে রাখতে পারে মাত্র। তবুও গভীর প্রেমে পড়ার পর একজন অন্যজনকে বলে, ‘তুমি আমার চিরদিনের, জন্ম জন্মান্তরের’ জাতীয় সংলাপ। কেন বলে? বলে, সঠিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার অভাবে। বলে অনেকটা ভয় থেকে। প্রেম সম্পর্ককে স্থায়ী করার অলিখিত চুক্তি আর নিশ্চয়তা হিসেবে। যখন সে এসব কথা বলছে, তখন সে বুঝতেও পারছেনা, আজ যাকে এতো ভালো লাগছে, পরিবর্তনের অনিরুদ্ধ রাতে মন বা হৃদয়ের চাহিদা বদলে গেলে, কাল তাকে আর ভালো লাগবে কিনা। এক মুহুর্ত পরে কী ঘটবে তা জানার উপায় যেখানে মানুষের নেই, সেখানে জন্ম জন্মান্তরের নিশ্চয়তা দেবার পরে যখন সম্পর্কের ভাঙ্গন শুরু হয় এবং তা অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন একজন অন্যজনকে কী বলে? ‘মিথ্যেবাদী’ ‘অবিশ্বাসী’ ‘ভণ্ড’ ‘প্রতারক’ সহ এ ধরনের যত শব্দ আছে সবই কী ব্যবহার করে না? অবশ্যই করে। ভেতরের সবটুকু ঘৃণা বের করে দিতে, ক্ষত-বিক্ষত মনটাকে সুস্থ করে তুলতে এসব শব্দ টনিকের মতই কাজ করে।
“নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে, এটা তাদের নিয়তি। এবং আরো মর্মান্তিক নিয়তি হচ্ছে, তাদের আকর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হবেনা,” লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ। কিন্তু কেন তাদের আকর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হবেনা, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। গবেষকদের মতে, মানুষের অন্যান্য অনেক নেশার মতো প্রেম ও এক বিশেষ ধরনের নেশা। তবে এই নেশা অন্যান্য নেশার তুলনায় অল্পায়ু। প্রেম হচ্ছে অ্যামিন, ইথাইল, ফিনাইলের জৈব রাসায়নিক নেশা। কারো প্রতি প্রেম আকর্ষণ অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে, মাথা থেকে এই রাসায়নিক জোয়ার, স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে রক্তকে নির্ভর করে সারা শরীরে প্লাবিত হয়। আর তা থেকেই বিভিন্ন রকম প্রেম উপসর্গ দেখা দেয়। কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে, এই রসায়ন শরীরের ভেতরে একটা টলারেন্স তৈরী করে এবং তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এর সাথে লড়ার মতো প্রেমের নেশা শরীর আর তৈরী করতে পারেনা। যার ফলে প্রেমানুভুতি তার তীব্রতা হারাতে শুরু করে। টলারেন্স যত বাড়ে, তত কমে আসে প্রেম। কমতে কমতে শিথিল হয়ে যায় এই সম্পর্ক। প্রেম অভিলাসী মানুষেরা বিচলিত, বেদনাহত হয়ে পড়েন। তবুও জীবন্ত করে তুলতে পারেন না এই নিস্ক্রিয়তা, শিথিলতা।
প্রেম সম্পর্কের এক পর্যায়ে নর-নারী দেহস্পর্শের যে সুখ পেতে চান, তার কারণও অক্সিটোসিন নামের এক জৈব রাসায়নিক, যা মানুষের রক্তে মাত্রাভেদে মিশ্রিত থাকে। অধিকাংশ প্রেম সম্পর্কের নির্ধারিত গন্তব্য হচ্ছে দেহজ সুখ। প্রেম অনুভূতি দেহের বা যৌন সুখের মধ্যে তার গন্তব্য খুঁজে না পেলেও, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে এই সম্পর্কের জোয়ারে ভাটা পড়তে থাকে। প্রতিটি প্রেমের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে প্রকৃতি। গড়ে প্রায় চার বছর। বিয়ে নামধেয় প্রথার বাঁধন ও কোন শক্তিময় ভুমিকা রাখতে পারেনা এ ব্যাপারে। বরং দ্বৈত জীবনকে, প্রেম সম্পর্ককে করে তুলে একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। সুদীর্ঘ সময় একত্রে জীবন যাপন করা মানেই প্রেমানুভূতির মাধুর্যে আপ্লুত জীবন নয়। অনেক রকম দায় দায়িত্বের জটিল শেকলে আবদ্ধ হয়ে একত্রে থাকার অভ্যাস মাত্র।
বাংলাদেশের মতো দেশে, নারী পুরুষের সব রকম পরনির্ভরশীলতাও একই সংসারের বৃত্তে আজীবন আবদ্ধ থাকার প্রধান কারণ। ক’বছর একত্রে থাকার পরে নর-নারী উভয়েই যখন অনুভব করেন, তাদের শরীর এবং মনের সম্পর্কের ভেতর এক অনিবার্য দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে, তখন তা অতিক্রম করার উপায় হিসাবে অথবা এই দূরত্বের মধ্যে সেতু নির্মাণ করার উদ্দেশ্য, একটি শিশুর জন্মকে বিশেষ প্রেসক্রিপশন হিসেবে গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে দেখা যায়, ঐ ছোট্ট মানুষটিও বাবা-মায়ের প্রেম সর্ম্পক টিকিয়ে রাখার পেছনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তখন তারা দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শিশুর প্রয়োজনের কথাও ভাবতে থাকেন। ভাবেন না কেবল, পৃথিবীতে এনেও ফেলেন। তারপরেও স্থায়ী হয়না তাদের প্রেম সম্পর্ক। স্থায়ী কেন, বেঁচেও কী থাকে কিছু? বিলীন হয়ে যাওয়া ঐ নেশাই জন্ম নেয় নতুন নতুন ভাবে, বার বার। কিছু দিনের বিরতির পরে ‘খুব ভালো লাগছে’ এমন একজনের দেখা পেলে, আবার তৈরী হয় প্রেম। সংসারে আবদ্ধ যারা, তাদের অনেকেই মন ও শরীরের মুক্তি খুঁজেন সংসারের বাইরে এসে। এই মুক্তি খোঁজার সত্যটাকে স্বীকার করেন না, কেবল লজ্জা এবং ভয়ে। অবশ্যই তারা বুঝতে চাননা, ‘গোপনও কথাটি রবেনা গোপনে’।
মানুষের যৌন সর্ম্পকের শুরু থেকেই চালু ছিল, বহুগামিতার প্রাকৃতিক নিয়ম। প্রাকৃতিক নিয়মেই মানুষ বৈচিত্র্য প্রত্যাশী, শরীরে ও মনে। সেজন্যই বহুগামিতা অপরাধ বলে গন্য হয়নি সে সময়। আদিম সমাজে কোনো নারী পুরুষই একসাথে থাকতেন না বেশী দিন। প্রেম সর্ম্পকের অবনতি হলে, সে সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন করে দেয়াই তারা যথার্থ এবং উচিৎ বলে মনে করতেন। যে কোনো কিছুই জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা যে অন্যায় অগণতান্ত্রিক, সে শিক্ষা তারা অর্জন করতে পেরেছিলেন প্রাকৃতিকভাবে। ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করতে পারি এভাবে, একই খাবার কি প্রতিদিন খেতে পারি আমরা? একই পোশাক প্রতিদিন পরতে কি ভালো লাগে আমাদের? অবশ্যই লাগেনা। মানুষের শরীরও তাই অন্য একটি শরীরের নিয়মিত সান্নিধ্যে হয়ে উঠতে পারে বিরক্ত এবং ক্লান্ত। মানুষ বৈচিত্র্য ভালোবাসে, এই বৈচিত্র্য প্রত্যাশা তার শরীর বহির্ভূত নয়। আর তাই নিত্যদিনের ঘড়ায় তোলা জলে স্নান করেও দীঘির জল দেখলে তাতে স্নান করার ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে পারেন ক’জনে?
মানুষের প্রতিটি প্রেমই তার প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারিত অধিকার। সমাজ নির্মিত আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কোন কোন প্রেম। কিন্তু আবেগ অনুভূতি কী পেরেছে তা মেনে চলতে? ক’জন বিয়ের লাইসেন্স ধারী নরনারী অপরাধের কথা মনে রেখে এড়াতে পেরেছেন পরকীয়া প্রেম? ক’জনের কাছে ঘরের স্ত্রী বা স্বামীর চেয়ে পরের অল্প দেখা, অল্পজানা, স্ত্রী অথবা স্বামীর আর্কষণ বেশী বলে মনে হয়নি? ক’জন পেরেছেন ধর্ম, আইন ও সমাজ নির্দেশিত জীবন যাপন করতে?
সবার উপরে সত্য হচ্ছে এটাই, প্রেম ও যৌনতা মানুষের জীবনের জন্য খুবই জরুরী একটি ব্যাপার। ঠিক যেমন জরুরী প্রতি দিনের খাওয়া এবং ঘুম। প্রকৃতির দেয়া এই অনুভূতিকে জোর করে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলে, তার প্রতিক্রিয়া হয় বিকৃত। আর তা দূষিত করে মানুষের জীবন ও সমাজকে। কাম অতৃপ্ত জাতির বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। যে প্রক্রিয়ায় মানুষ জন্মায়, যা মানুষের শরীর ও মনকে সুস্থ ও সুখী করে, তা নিয়ে সুস্থ সঠিক আলোচনা না করে, অশ্লীলতা করলে, অথবা লজ্জার আবরণে ঢেকে রাখলে, জীবনের প্রায় অর্ধেক জরুরী ব্যাপারটাকেই আবৃত করে রাখা হয়। আর তাতে সমাজও সঠিক পথে এগোয় না।
প্রেম ও যৌনতা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ লেখালেখি করা মানে, সমাজের মানুষকে যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, বা অবাধ যৌনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করা নয়। বরং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এ সব বিষয়ে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ সুন্দর আলোচনা থেকেই সম্ভব হবে, সমাজের মানুষকে বিকৃতির হাত থেকে বাঁচানো। প্রেম ও যৌনতাকে সঠিক, রুচিস্নিগ্ধ সুন্দর পথে পরিচালিত করা। সত্য, সুন্দর ও সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, সেই শিক্ষাকে নিজের জীবনে যিনি প্রয়োগ করতে পারেন, মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করার সনদ পত্রটি তারই হাতে তুলে দেয় প্রকৃতি।
মানুষের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার কাঁচি, মানুষের হৃদয়ের উপর চালানো যায়নি। যায়নি বলেই, প্রেমে পড়লে প্রতিটি মানুষ তার প্রেমিক, প্রেমিকার সাথে আচরণ করেন তার নিজের স্বভাব মতো। তারপরেও আমার ধারণা, পৃথিবীর বেশীর ভাগ প্রেমিক প্রেমিকা প্রবল আবেগায়িত অবস্থায় একে অন্যকে যে সব কথা বলেন, অধিকাংশ প্রেমের গান, কবিতায়, সাহিত্যে যে প্রেমাবেগ প্রকাশ করেন তার ধরন অনেকটা একই রকম। ‘তুমি আমার’ ‘তোমাকে পেলে আমার আর কিছুই চাইনা’ ‘তোমার চেয়ে বেশী সুন্দর আর কেউ নয়’ ‘আমি কোন দিন তোমাকে ছেড়ে যাব না’ ‘সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসবো’ ‘আমি তোমাকে আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসি’ ধরনের সংলাপ কী সব প্রেমিক প্রেমিকাই কোন না কোন সময় বলেননি? হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এ রকম সব কথা, আমার মতে অজ্ঞানে অসচেতনে করা প্রতারণা। কীভাবে? বলছি। এই যে প্রেমের সংলাপ লিখলাম, এগুলোর সবই কী চূড়ান্ত কথা বলে দেয়া নয়? কিন্তু আমরাতো জানি, প্রকৃতিতে অ্যাবসুলুট বা চূড়ান্ত বলে কিছু নেই। তাহলে এরকম চূড়ান্ত কথা বলা বা লেখার অধিকার আমাদের থাকে কী করে?
“তুমি আমার” একথা কাউকে বলার আগে অন্তত একবার ভেবে দেখা দরকার, এ পৃথিবীতে কী সত্যিই কেউ কারো হতে পারে? যেখানে মানুষ নিজেও তার নিজের নয়, প্রকৃতির ক্রীড়ানক মাত্র। নিজের বলে কাউকে ভাবার আগে, ‘কা তব কান্তা’ র মতো সত্য জীবন দর্শনটি মনে রাখলে, সম্ভবত তা আমাদের এরকম মিথ্যে আবেগের মধ্যে ভারসাম্য তৈরী করে, সঠিক চেতনার পথে এগিয়ে দেবে।
‘তোমাকে পেলে আমার আর কিছু চাইনা’ বলার আগে নিজেকেই প্রশ্ন করা দরকার, সত্যিই কী তাই? তাকে পেলেই কী অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, অর্থসহ অন্যান্য সব প্রয়োজন মিটে যায়? যায় না। যায় না বলেই যদি এভাবে বলা যায়, ‘আমার জীবনের সুখকে সমৃদ্ধ করবার জন্য তোমাকে চাই’ তাহলেই কী প্রেমের সংলাপ যুক্তি সংগত হয়ে উঠে না? ‘তোমার চেয়ে বেশী সুন্দর আর কেউ নয়’ তাকে খুশী করার জন্য এরকম কথা না বলে যদি বলা হয়, ‘তোমাকে আমার কাছে ভারী সুন্দর লাগে’ তাহলেই কী তা সততায় অনন্য হয়ে উঠে না? ‘আমি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না’ না বলে, যদি বলা হয় ‘যতদিন সম্ভব তোমার কাছেই থাকব’ তবে কী তা মিথ্যা বলা হবে?
‘সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসব’ বলার মতো নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি, কী কেউ কাউকে দিতে পারেন আসলে? পারেন না। কারণ মানুষের জীবনের সব কিছুই হচ্ছে রিলেটিভ। প্রায় সব কিছুই নির্ভর করে অন্য কিছুর উপরে। যাকে মানুষ ভালোবাসে, তার প্রতি মুহূর্তের আচরণের উপর নির্ভর করে, তাকে কতটা ভালোবাসা যায়, এবং কতদিন। তাই, সঠিক হয়ে উঠবে সংলাপ, যদি বলা হয়, ‘এই মুহূর্তে তোমাকে আমি আমার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে ভালোবাসি, এখন এটাই সত্যি’।
‘আমি তোমাকে আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসি’ একথা কাউকে বলা মানেই হচ্ছে, অচেতনে মিথ্যেবাদী হওয়া। মনে রাখা ভালো, ৯৮ ভাগ মানুষ বেঁচে থাকে, মূলত তার নিজের প্রতি প্রবল প্রেমের ভিত্তিতে। তাই নিজের চেয়ে বেশী ভালো সে কাউকেই বাসতে পারেনা। মা তার সন্তানকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশী ভালোবাসেন বলে আমার মনে হয়না। যদি তাই হত, তাহলে সন্তানের মৃত্যুর পরও মা বেঁচে থাকতে পারতেন না। এরকম কথা যারা বলেন, তাদেরকেই ভেবে দেখতে বলছি, এসব কথা সত্য এবং সঠিক কিনা। যা মিথ্যা তা বিশ্বাস করলে কী ঠকতে হয়না? হবে না এক সময়?
ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা, সুচিন্তিতভাবে সঠিক এবং যৌক্তিক করে তুলতে পারলে, এই সম্পর্ক সমৃদ্ধ এবং যথার্থ হয়ে উঠবে সততায়। এক সময়ে যে কোনো কারণে প্রেম সম্পর্কের মৃত্যু হলেও, একজনের প্রতি অন্যজনের শ্রদ্ধা বোধ হারিয়ে যাবে না। অসততা বা মিথ্যাচারের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে না কাউকেই। বন্ধুত্ব রূপান্তরিত হবেনা ভয়াবহ শত্রুতায়। প্রেম না থাকুক, পরিচয়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যাবে। আর সেটাই কী হওয়া উচিৎ নয়? সংলাপ ছাড়াও, আরও কিছু বিষয়ে মনোযোগী হলে প্রেম সম্পর্কের স্থায়িত্ব বাড়ানো যেতে পারে।
এক, তার কাছ থেকে সব ব্যাপারেই নিজের ইচ্ছে বা পছন্দমতো বেশী কিছু প্রত্যাশা না করে, তার সব ধরনের যোগ্যতা ও গুণাবলীর কথাও মাথায় রাখা। সে কতটা দিতে পারে তার পরিমাপ করে প্রত্যাশা করা, অথবা না করা।
দুই, তার কাছেই নয় কেবল, যে কারও চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় না দেয়া, এবং অপছন্দ করা।
তিন, দু’জনের মধ্যে বেশীরভাগ ব্যাপারেই নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরী করে, তা মেনে চলা।
চার, দু’জনের একান্ত সময়ের প্রতি সম্মানিত থাকা, বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে প্রতিটি দিনকে অন্যতম একটি দিন করে তোলা।
পাঁচ, তার ভালোলাগা, মন্দ লাগা, ব্যক্তি সত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে, শ্রদ্ধা করে সম্পর্ক রক্ষা করা।
ছয়, ‘তার কাছে কী পেলাম’, কেবল একথা না ভেবে, ‘তাকে কী দিলাম’ সেটা একটু বেশী ভাবতে চেষ্টা করা। সম্ভব হলে দিতেও চেষ্টা করা।
সাত, ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা ও মনোযোগ পাবার জন্য সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে, এ ব্যাপারে সব রকম যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করা। একমাত্র তাহলেই এই সম্পর্কের আকর্ষণ এবং স্থায়িত্ব বাড়িয়ে তোলা হয়তো অসম্ভব হবে না। আর তার ফলাফল, প্রায় সবটাই হবে পজেটিভ।
যারা আমার সাথে একমত হতে পারছেন না, যারা এখনো ভাবছেন, সবটুকু হৃদয় মন যাকে দিয়েছি, যদি ভাবতেই না পারি, ‘সে আমার, চিরদিন সে আমার’ তাহলে কী করে এই সম্পর্ক তার ভিত্তি খুঁজে পাবে। কী করে ভালোবাসা হবে তীব্র? তাদের জন্য বলছি, আজ আপনার যে চিন্তা চেতনা, দশ বছর আগেও কী তা এমনই ছিল, সব ব্যাপারে? ছিলনা, তাইনা? তাহলে আজ যাকে আপনার ভাবছেন, কাল যদি তাকে আর সে রকম মনে না হয়, কী করবেন? বলবেন, ‘তুমি আমারই?’, হয়তো বলবেন না। বরং একসময় যে বলতেন সে জন্যই হয়তো কষ্ট হবে, খারাপ লাগবে। বাগানের ফুল কী আমাদের? তাই বলে কী আমরা ফুলকে ভালোবাসি না? মুগ্ধ কী হয়ে উঠিনা তবুও?
সুখ স্বল্পস্থায়ী হয়, যদিও তবু তা সুখ।
সব ব্যাপারেই দু’একটা ব্যতিক্রম থাকে। তা আপনিও জানেন, আমিও জানি। ব্যতিক্রম বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা দিয়ে কী সার্বিক, বা ইনজেনারেল অবস্থার ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন করা যায়? না তাতে সত্যকে উদ্ধার এবং প্রচার করা সম্ভব হয়? আর সত্য যদি সঠিকভাবে উদ্ধারই না করা যায়, তাহলে কী সত্য বলা বা লেখা সম্ভব?
নোট: প্রবন্ধটি লেখিকার টিনএজ বয়সে লেখা।