সমীরণ বিশ্বাস: কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে জাতীয় আয়ের বৃহৎ অংশ কৃষিজ উৎস থেকে আসে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষিতে ৭০ ভাগ মানুষ নিয়োজিত থাকার পরও প্রাক-বাজেট আলোচনায় এই শ্রেণি-পেশার মানুষের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না।
আরও পড়ুন: উন্নয়নে সামাজিক মূলধনের ভূমিকা
তৃণমূল কৃষকদের একান্তই চিন্তা এবং ভাবনা, তাদের কৃষি সংশ্লিষ্ট দৈনন্দিন সমস্যা, চাওয়া-পাওয়া এবং সুপারিশগুলো মাথায় রেখে জাতীয় বাজেট প্রতিফলিত হবে। এমন আশা আমাদের দেশের সব কৃষকদের।
আগামী বাজেটে কৃষির সবগুলো খাত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে। মূলত জাতীয় বাজেটের সঙ্গে কৃষকের চিন্তা এবং ভাবনাকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই সত্যিকারের একটি কৃষিবান্ধব জাতীয় বাজেট প্রতিফলিত হবে।
কৃষিতে কৃষকের সমস্যা:
বর্তমান সময়ে মাঠ পর্যায়ের কৃষকের সমস্যাগুলো তুলে আনতে পারলেই আগামীতে একটি সঠিক, সুন্দর ও কৃষিবান্ধব বাজেট প্রণয়ন সম্ভব। তারই আলোকে কৃষকের যেসব সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তা হলো—কোথাও কোথাও কৃষকের আবাদি জমিতে অবৈধ বালু ফেলা হচ্ছে, চর অঞ্চলের কৃষকরা সহজ শর্তে কৃষি ঋণ পাচ্ছে না, তিন ফসলি জমি ও দুই ফসলি জমি পরিকল্পিতভাবে পুকুর ও খাল খনন করা হচ্ছে, যার ফলে জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।
অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বা কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর ব্যবহার সম্পর্কে কৃষকের অবগত না হওয়া, নির্ধারিত মূল্যে সার না পাওয়া, সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে পানি সেচের ব্যবস্থা না থাকা, কৃষি কাজে বিদ্যুতের ভর্তুকি চলমান না রাখা, স্থানীয় পর্যায়ে দুধ সংরক্ষণ চিলিং—সেন্টার ও বিক্রির সুযোগ সুবিধা না থাকা, সবজি এবং ফল ফসলের সংরক্ষণাগার না থাকা।
জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা ইস্যু, মাটির স্বাস্থ্য, কৃষির বহুমুখী পরিবর্তন ও মানুষের জীবনধারা সামনে রেখেই কৃষি গবেষণা শুধু ফসলের জাত উদ্ভাবনে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। এখন সামগ্রিক কৃষি গবেষণার দিকে নতুন করে নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
আরও পড়ুন: বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট চাই
কৃষির সব খাতে বীমা সুবিধা না থাকা, জলবায়ু সহনশীল কৃষি উদ্ভাবনে গবেষণায় যত পর্যাপ্ত বরাদ্দ তা না থাকা, প্রাণী খাদ্যে ভর্তুকির সুযোগ না থাকা, ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থার স্বল্পতা।
লোডশেডিংয়ের সমস্যা, ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, প্রাণী খাদ্যের মান সঠিক না থাকা, মাছ ও হাঁস-মুরগি খাতে ভর্তুকি না দেওয়া, বীজ ও সারের দাম বৃদ্ধি।
শীতকালীন ফসলের হিমাগার না থাকা, সরকারের সঠিক সময়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় না করা, পরিকল্পিত নদী শাসন করে কৃষি জমি রক্ষা না করা, মৌসুম ভিত্তিক ফল-ফসলের সরকারি পরিবহন সহায়তা না থাকা, স্যারের প্যাকেটে উৎপাদন ও মেয়াদকাল না থাকা কৃষির বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজেটে কৃষকের চাওয়া: স্মার্ট জনশক্তি স্মার্ট বাংলাদেশের প্রধান ভিত্তি
কৃষি ও কৃষকের বাজেট প্রণয়নে সুপারিশ হলো—সব ধরনের কৃষিতে বিশেষ করে জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুতের ভর্তুকি চলমান রাখা এবং কৃষি খাতে বীমা সুবিধা চালু করা। জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষি উদ্ভাবনে গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা কৃষকের সময়ের দাবি।
জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা ইস্যু, মাটির স্বাস্থ্য, কৃষির বহুমুখী পরিবর্তন ও মানুষের জীবনধারা সামনে রেখেই কৃষি গবেষণা শুধু ফসলের জাত উদ্ভাবনে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। এখন সামগ্রিক কৃষি গবেষণার দিকে নতুন করে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে গবেষণার বরাদ্দে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই গবেষণা কাজ বাড়াতে হবে।
আরও পড়ুন: শ্রমিকের নিরাপদ কর্মপরিবেশ চাই
শিক্ষিত তরুণদের জন্য বিশেষ কৃষি উদ্যোগ প্যাকেজ প্রণয়ন করা। প্রাণী খাদ্যের মান বজায় রেখে; প্রাণী খাদ্যে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদের সার ও যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি চলমান রাখতে হবে।
কৃষি ফসলের মতো, মাছ ও হাঁস-মুরগি পালনেও ভর্তুকি দিতে হবে। ফল ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণ তথা সংরক্ষণের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিকের পরিবর্তে, কৃষি বিল হিসেবে বিবেচনা করার দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
কৃষি এখন শিল্প। তাই কৃষক এবং শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে একটা অংশীদারমূলক নীতিমালা প্রয়োজন। সর্বোপরি কৃষকরা যাতে সহজ শর্তে কৃষি ঋণ পায় তার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, সরকারি নির্ধারিত মূল্যে কৃষকরা যাতে প্রয়োজনীয় সার পায় তার কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ফসলি জমিতে সহজে পানি সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বল্প ও ন্যায্য মূল্যে কৃষকরা যাতে মানসম্পন্ন বীজ ক্রয় করতে পারেন তার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, সরকার যেন সঠিক সময়ে কৃষকের কাছ থেকে সঠিক মূল্যে ধান ক্রয় করে তাহলে কৃষকরা স্বাবলম্বী হবেন। কৃষি এখন শিল্প। তাই কৃষক এবং শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে একটা অংশীদারমূলক নীতিমালা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: ঈদের অর্থনীতিতে নারীর অবদান
পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। আমাদের এই অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বৃক্ষশূন্য প্রকৃতিতে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। সময়ে তীব্র দাবদাহে পুড়ছে ঢাকাসহ দেশের সব শহর-নগর।
গ্রামের চেয়ে নগরের পরিবেশ অনেক বেশি উষ্ণ। কলকারখানা, গাড়ির কালো ধোঁয়া, আর জনসংখ্যার চাপে নাভিশ্বাস মানুষের। এই পরিস্থিতিতে ছাদকৃষি বা নগরকৃষি আমাদের অক্সিজেন কারখানা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এই সময়ে ছাদকৃষির বিষয়ে একটি সমন্বিত ও বড় প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।
এখন স্টার্ট-আপের যুগ। কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ এবং ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে আধুনিক স্মার্ট কৃষিতে রূপান্তরের জন্য সময়োপযোগী প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। সর্বোপরি কৃষকরা যাতে সহজ শর্তে কৃষি ঋণ পায় তার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের দেশে কৃষি-বাজেট এবং বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত দেশে ফরমাল রিটেইল মাত্র ২ শতাংশ। বাজার ব্যবস্থাপনা ভালো থাকলে সাপ্লাই সিচুয়েশন ইম্প্রুভ করবে। ফলে কৃষক/খামারি রিটেইল চেইনে ভালো দামে বিক্রি করতে পারবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে; কৃষিকে অবশ্যই যান্ত্রিকীকরণ, ডিজিটালাইজেশন এবং আধুনিক কৃষিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি সম্বলিত স্মার্ট কৃষি বাজেট ও কৃষি ব্যবস্থাপনায় রূপান্তরের এখনই সময়। আমাদের স্মার্ট কৃষিতে যেতে হবে। মাঠ পর্যায়ের কৃষকের এখন একটাই চাওয়া আসন্ন জাতীয় বাজেট যেন কৃষিবান্ধব হয়।
লেখক: কৃষিবিদ