অলোক আচার্য: অর্থনৈতিক সংকট একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় আঘাত করে, এর বড় উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে খারাপ অবস্থা বিরাজ করবে, সে আভাস পূর্বেই দেওয়া হয়েছিল। এখনো বিশ্বের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তীব্র লড়াই করছে। সেই সঙ্গে রয়েছে খাদ্যসংকট এবং অন্যান্য সমস্যা। সমস্যার শুরু হয় গত বছর। গত বছরের শুরু থেকেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি থেকে রাজনীতি অত্যন্ত খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে। অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে এবং তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয় এবং চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ ধৈর্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। যদিও সেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পূর্বের তুলনায় এখন স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু, অর্থনীতি সেই সংকটেই রয়েছে। সংকট থেকে উত্তরণে নানা পন্থায় অগ্রসর হচ্ছে দেশটি—ঋণ নেওয়ার চেষ্টা, নিজেদের অর্থনীতির খাতগুলোকে শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: ৭ জেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা
দক্ষিণ এশিয়ার আরও একটি দেশ এখন চরম অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। দেশটি পাকিস্তান। সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইতিহাসের চরম নাজুক অবস্থায় রয়েছে এবং বৈদেশিক ঋণ ছাড়া উদ্ধারের রাস্তা নেই। এখনও দেউলিয়া না হলেও শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে। অর্থাৎ অর্থনীতির ধ্বসের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছে দেশটি। রিজার্ভ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। গত মাসে পাকিস্তানের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৪৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চরম আকার ধারণ করেছে। জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। জরুরি খাতগুলোতেও এই অর্থনৈতিক সংকটের আঁচ এসেছে। ওষুধ সংকটের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যেরও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্যা আবশ্যিকভাবেই আঘাত করছে সংসারে। এ সংকটে বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারানো শঙ্কায় রয়েছেন। ব্যয় সংকোচনে যুক্ত হয়েছেন সরকারি মন্ত্রী, আমলারাও। অর্থাৎ সবাই মিলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু, এর সাথে আবশ্যকিভাবে প্রচুর অর্থের দরকার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এর জন্য অনেকটাই দায়ী।
শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি যে অন্য দেশেরও হতে পারে, সে পূর্বাভাস গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময় কয়েকটি দেশের নাম উঠে আসে, যারা খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পরতে যাচ্ছে বলে আভাস দেওয়া হচ্ছিল।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যগুলো ‘পক্ষপাতদুষ্ট’
গত বছরের মাঝামাঝি এনডিটিভির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, শ্রীলঙ্কা, লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম ও জাম্বিয়া এরইমধ্যে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। বেলারুশসহ কিছু রাষ্ট্র সে পথে হাঁটছে। এছাড়া, সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে যে দেশগুলোর নাম উঠে আসে, তার মধ্যে ছিল— আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, ইউক্রেন, বেলারুশ, তিউনিশিয়া, ঘানা মিশর, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইকুয়েডর এবং এল সালভাদর। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান ছাড়াও অনেক দেশই খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির শিকার। সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছতাসাধনেও কার্যত কোনো ফল আসছে না। কারণ, যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিস্থিতি ফেরাতে ভূমিকা রাখতে পারে, তার কম অংশই পাওয়া যাবে। তার চেয়ে বড় কথা, এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। মোটা অঙ্কের তহবিল দরকার এই মুহূর্তে। প্রথমে আমদানি করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় আমদানি করতে হবে। এজন্য পাকিস্তান আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে এবং বেশকিছু কঠিন শর্তেও রাজি হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত সংবাদে এই তথ্য জানা গেছে। রাজি হওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে বেশি বিকল্প পাকিস্তানের হাতে নেই। কারণ, দেশটির রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে এবং প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো সামান্যই রয়েছে। পাকিস্তানের এ অবস্থা কেন হয়েছে বা হলো, তার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণে যেসব কারণ উঠে এসেছে, সেখানে শ্রীলঙ্কার সাথে পুরোপুরিভাবে মিলে না গেলেও কিছু বিষয় মোটামুটিভাবে মিলেই যায়। এই পরিস্থিতির পেছনে রাজনৈতিক কারণ, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে পয়েন্ট করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এই বিষয়গুলো যদি কোনো দেশে সমানতালে অর্থাৎ একইসাথে ইতিবাচকভাবে অগ্রসর হয়, তাহলে সেই দেশের উন্নয়ন সুনিশ্চিত। যদি এর বিপরীত হয়, তাহলে পতনও সুনিশ্চিত। পাকিস্তানের আমদানি নির্ভরতাও এর পেছনে অনেকটা দায়ী। দেশটি আমদানির পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। আমদানি-রপ্তানি একটি দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম। কিন্তু, অতি নির্ভরশীতা যে কমানো উচিত, সেই শিক্ষা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব পেয়েছে। যে পণ্যগুলো আমদানিনির্ভর, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেই দেশেও দাম বৃদ্ধি পায় এবং অস্থিরতা তৈরি হয়। সংকট মোকাবিলায় পাকিস্তান আইএমএফের কাছ থেকে ৬৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে বেশকিছু দিন ধরেই চেষ্টা করছে। কিন্তু, সংস্থাটির শর্তের কারণে প্রথমটায় রাজি না হলেও পরে রাজি হয়েছে। কঠিন শর্তগুলোর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি ছিল। তবে, আপাত সংকটের সমাধান করতে হলে এ ঋণ তাদের প্রয়োজন। অর্থ সংকট অতি প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর আমদানি বাধা সৃষ্টি করবে এবং যার ফলে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন: লক্ষ্মীপুরে তিনজনের যাবজ্জীবন
এদিকে, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে এখনও বেশ সংগ্রাম করে চলেছে। দেশটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানির মতো অর্থেরও ব্যাপক সংকট রয়েছে। এরইমধ্যে বর্তমান সরকার বহু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে। নানাভাবে ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে দেশটির সরকার। কৃচ্ছ্রতাসাধনে সরকারি নিয়োগ স্থগিত ও চাকরির মেয়াদ কমিয়ে আগাম অবসরের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। এরপর সেনা সংখ্যাও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। শ্রীলঙ্কায় ৩ লাখ ১৭ হাজার সেনার বিশাল বাহিনী থেকে তা কমিয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজারে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানোর অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। অর্থনীতি থেকে রাজনীতির উত্থান-পতনের স্বাক্ষী দেশটি।
পাকিস্তানে এখন অর্থনৈতিক সংকট চলছে। শ্রীলঙ্কার পর পাকিস্তান কোন পথে হাঁটবে, এখন সেই প্রশ্ন সামনে। ঋণ নিয়ে আপাত সমস্যার সমাধান হলেও ঋণের বোঝা পরিশোধ করা, দেশের মানুষের জীবন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করা অর্থাৎ পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবেই সরকারকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব ক্রমেই মুদ্রাস্ফীতির কবলে পরে এবং খাদ্য সরবরাহ, জ্বালানি সরবরাহ প্রভৃতি কারণে জীবনযাত্রার মান কমতে থাকে। এর মধ্যে যে দেশটি প্রথমে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার করছে সেটি শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার সমস্যার শুরু হয়েছিল অর্থনৈতিক সংকট থেকে, পাকিস্তানেরও সেভাবেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট