সৈয়দ মেহেদী হাসান, বরিশাল থেকে:
কথায় বলে, শীত গেলে কাঁথা যায় পায়ের কাছে। তেমনি দুঃসময়ে জনগণকে এড়িয়ে চলছেন বরিশালের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিবিদ। ব্যতিক্রম কেউ কেউ থাকলেও অধিকাংশদের প্রতি সাধারণ মানুষের উষ্মা তাই বাড়ছে দিনে দিনে। যদিও করোনার সময়ে যেসব নেতাদের মানুষের পাশে দেখা যায়নি, করোনার প্রভাব কমে আসায় তারা আবার আড়াল ভাঙতে শুরু করেছেন। এ নিয়ে বরিশালে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
স্বাস্থ্য দপ্তর বলছে, বরিশালে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় পাঁচমাস আগে। এরপর থেকে রোগী আর মৃত্যু দিন দিন বেড়ে চলে। ওই সময়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোতো দূরের কথা, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলনের মতো প্রথম সারির দলগুলোর অধিকাংশ নেতাদের কোনো হদিস ছিল না।
তবে করোনার মধ্যেও মাঠ চষে বেড়িয়েছেন বরিশাল সদর আসনের সংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম। করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। জাহিদ ফারুক শামীমের তত্ত্বাবধানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে সরকারি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। জনগণের সঙ্গে সরাসরি দেখা না দিলেও করোনায় কমপক্ষে ৮০ হাজার মানুষকে সরকারি সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।
আর সাংগঠনিক উদ্যোগে কেবলমাত্র বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) রয়েছে মানুষের পাশে। মানবতার বাজার, ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, মানবতার স্কুল, অক্সিজেন ব্যাংক, করোনা প্রতিরোধী সামগ্রী বিতরণ, রেশন কার্ড পদ্ধতিতে বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের মতো মানবিক কাজ করে ইতোমধ্যে জনপ্রিয় নেতৃত্বে পরিণত হয়েছেন বরিশাল জেলা শাখার আহবায়ক প্রকৌশলী ইমরান হাবিব রুমন ও সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী।
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদের পিছুহটার আচরণ জনগণের কাছে তাদেরকে আরও ব্যক্তিত্বহীন করে তুলেছে। কারণ, করোনায় বরিশালের বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। এই সময়ে মানুষের আস্থা অর্জন করতে নেতাদের সচেষ্ট হওয়ার দায়িত্ব থাকলেও উল্টো তারা জনসম্পৃক্তহীন হয়ে পড়েছেন। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝেও কার্যক্রমহীনতা দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই নীরবতা জনগণ সহজভাবে নেয়নি বলে মনে করেন প্রবীন আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এস এম ইকবাল। তিনি বলেন, বরিশালের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড ছিল লোক দেখানো। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরিশালে দলীয় ভাবে কোনো কাজ করেনি। তবে বাসদ ভালো কাজ করেছে। বিএনপিও তেমন কিছুই করেনি। করোনার এই মুহূর্তে উচিত ছিল সকলকে একজোট হয়ে মাঠে কাজ করা। যদি করতে পারতো তাহলে পরিস্থিতি আরও ভালো হতো।
গত ১২ এপ্রিল বরিশাল জেলায় আর ৯ মার্চ বিভাগে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস জানিয়েছেন, রোববার (৯ আগস্ট) পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ১২৪ জনের। শনাক্তের ১৫৩ দিনে ছয় হাজার ২৮৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
রিফুউজি কলোনির শাহিদা বেগম বলেন, ‘করোনার সময়ে কোনো নেতা একদিনের জন্য খোঁজ নেননি। ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের কাছে গিয়েছি। তিনি কথা শুনেছেন, কিন্তু কোনো উপকারে আসেননি। তবে সরকারের সাহায্য আমরা পেয়েছি মেয়রের মাধ্যমে।’
কাউনিয়ার বাসিন্দা ঝুনু বেগম বলেন, ‘সাহায্য দেবেন বলে এলাকার নেতা ও কাউন্সিলররা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়েছেন। কিন্তু এক কেজি চাল আজ পর্যন্ত পাইনি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে এম জাহাঙ্গীর, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস, মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়দুল হক চাঁন, উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কমিটির নেতা মহসিনুল ইসলাম হাবুল, মরতুজা আবেদীন ও ইকবাল হোসেন তাপস, ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীমের মতো প্রতাপশালী নেতাদের টিকিটিও দেখা যায়নি করোনার দুঃসময়ে। অথচ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এই নেতারা প্রথম সারিতে থেকে নিজেদের অবস্থান জানান দেন। কিন্তু যে জনগণের জন্য রাজনীতি তাদের খোঁজ নেওয়ার সময় হয়নি তাদের।
বাসদ বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা করোনার শুরু থেকে সাধারণ জনগনের পাশে আছি। শুধু বরিশাল মহানগর নয়, আমরা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও ত্রাণ বিতরণ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘করোনা প্রতিরোধে মূল দায়িত্ব সরকারের। সেখানে মহানগর এলাকায়ই করোনা সচেতনতা বা সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের বিষয় অবহেলিত হয়েছে এবং প্রান্তিক পর্যায়েও এই অবহেলা যথেষ্ট ছিল। তবে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুসারে চেষ্টা করেছি।’
জাতীয় পার্টি বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে এম মুরতজা আবেদীন দাবি করেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে অসহায় লোকদের সাহায্য করেছি। জাতীয় পার্টির ব্যানারে যেটুক করার আমি করছি।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘করোনা সচেতনতায় আমরা লিফলেট, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সাবান বিতরণ করেছি। আমরা ৩৫ জায়গায় রিলিফ পোগ্রাম করেছি। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও আমরা জনগণকে সাহায্য করেছি। এছাড়া ‘টুকটাক’ আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলমান।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর ব্যক্তি উদ্যোগে সহায়তার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘সর্বপ্রথম করোনা নিয়ে বরিশালের মানুষদের নিজ উদ্যোগে সচেতন হতে হবে। সরকার করোনা সম্পর্কে সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি ইতোমধ্যে পালন করেছে এবং প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর দিক-নির্দেশনায় ৮০ হাজার ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। সিটি মেয়র আর আমরাতো আলাদা না।’
তিনি সাধারণ মানুষের সমালোচনা করে বলেন, এখনও নগরীতে অনেককে মাস্ক ছাড়া চলাচল করতে দেখা যায়। এটা একটা আতঙ্কের বিষয়। নিজ উদ্যোগে মানুষ সচেতন না হলে কারোর কিছু করার থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।
করোনার মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের জনসেবা বিমুখতা দলগুলোকে জনবিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দেবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশালের সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা। তিনি মনে করেন, করোনাকালে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল। করোনা প্রতিরোধে বাসদের ভূমিকাও কম নয়।
তিনি বলেন, ‘বাসদ নিয়ে শুধু একটি কথাই বলতে চাই, তারা মানুষ হয়ে মানুষের মতো কাজ করেছেন। বাসদ বরিশালবাসীর মন জয় করেছে। কিন্তু বড় বড় দলগুলো করোনাকালে কেন চুপ ছিল তা মানুষকে হতবাক করেছে।’
শাহ সাজেদা মনে করেন, শুধু যে সরকার দিলেই হয়ে গেল, ব্যাপারটি তেমন না। ক্ষমতায় থেকে বা ক্ষমতার বাইরে থেকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দুঃসময়ে কিন্তু তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, করোনাকালে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ফেসবুকে ত্রাণ বিতরণের অনেক ছবি দেখা গেছে। সেগুলো কতোজন কর্মহীন মানুষের কাছে পৌঁছেছে, সেটি খতিয়ে দেখা জরুরি। স্থানীয় নেতারা তাদের নিকটস্থ লোকদের ত্রাণ দিয়েছেন, নাকি প্রকৃত অসহায়রা পেয়েছেন তা দেখা উচিত। আবার বিএনপি নেতা সরোয়ারের জন্য বরিশালবাসী অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু তিনি করোনা সংকটে বরিশালের মানুষের জন্য কিছুই করতে পারেননি তিনি। অধিকাংশ দলের নেতারাও একই আচরণ করেছেন। যা সবাইকেই আশাহত করেছে।
সান নিউজ/ এআর