ড. কবিরুল বাশার : এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ, শিল্প, বিদ্যুৎ এবং কৃষি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন চলছে। মেগা প্রকল্পগুলোও এগিয়ে চলছে। এসব মেগা প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সাথে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে, আর এর সুফল মানুষের কাছে পৌঁছতে শুরু করবে।
আরও পড়ুন : অমর একুশে এখন শোক নয় উৎসব
কোনো দেশ যখন দ্রুত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যায়, তখন বিভিন্ন খাতে সূচক বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে বায়ু দূষণ তেমনি একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং একে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, দেশে বায়ু দূষণজনিত রোগে প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যায় একই সঙ্গে দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ ক্ষতি হয়।
আরও পড়ুন : ঢাকার বায়ু কতটা অস্বাস্থ্যকর?
শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউট প্রকাশিত 'এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক পিএম ২.৫-এর পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি।
বায়ু দূষণ ও এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোও তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা এবং রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু ঝুঁকি পরিত্রাণে সরকারি সংস্থা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কার্যকর তৎপরতা চোখে পড়ে না।
আরও পড়ুন : মাতৃভাষার গুরুত্ব
বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক পিএম ২.৫-এর পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি...
বায়ু দূষণের ফলে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বাতাসে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্ষুদ্র ধূলিকণা থাকায় গাছপালার পাতায় ধুলো জমে গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের অনুপাত কম বেশি হচ্ছে।
আরও পড়ুন : বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
কয়েক বছর ধরে বায়ু দূষণের চিত্র আমরা ভয়াবহভাবে প্রত্যক্ষ করছি। এখন থেকে আরও ১০ বছর আগে বায়ু দূষণের উৎস ভিন্ন ছিল, এখন পরিবর্তিত হয়েছে। আগে প্রধান উৎস ছিল ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন বর্জ্য পোড়ানো।
বিগত ১০ বছরে বায়ু দূষণের উৎসগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। এখন সবচেয়ে বেশি দূষণ হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প ছাড়াও, ওয়াসা, ডেসকো, তিতাস ইত্যাদি সংস্থাগুলো যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে সেগুলোও বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
আরও পড়ুন : তীব্র প্রেমবোধ সর্বদা তাড়িত করেছে
শহরে যেদিকেই তাকাই সব জায়গা ধুলাচ্ছন্ন। প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি ইটভাটা অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন থেকেও প্রচুর দূষণ হচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮-ক অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষা রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি। যৌক্তিক ব্যবস্থা নির্ধারণের মাধ্যমে বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণ করতো : জনগণের বিশুদ্ধ বাতাস সেবনের অধিকার, জীবন, সম্পত্তির ও পরিবেশের উপর অধিকার।
এই অধিকার রক্ষাকল্পে ‘নির্মল বায়ু আইন, ২০১৯’ করেছে সরকার। এই আইন অনুযায়ী বায়ু দূষণের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল বা দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা কমপক্ষে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি পেতে হবে।
আরও পড়ুন : আমাদের বায়ু আমাদের আয়ু
এমন কঠিন আইন থাকার পরেও কমছে না বায়ু দূষণ। দূষণ না কমার মূল কারণ হচ্ছে মেগা প্রজেক্টগুলো করতে গিয়ে যে খোঁড়াখুঁড়ি করে তা কোনোরকম নিয়ম মেনে, পরিবেশ সংরক্ষণ করে করা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী তা করতে তারা বাধ্য। কিন্তু তারা কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে তাদের ইচ্ছামতো কাজ করছে।
এখানে জবাবদিহিতা তেমন চোখে পড়ে না। যারা এদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনবে তারা সেখানে ঠিকমতো মনিটরিং করছে না। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে যারা বড় বড় প্রকল্প চালান, তাদের বেশিরভাগই বিদেশি বড় বড় প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের দেশে বা অন্য কোনো দেশে পরিবেশ আইন মেনেই কাজ করেন, কিন্তু বাংলাদেশে করছেন না।
আরও পড়ুন : ভারত-বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় নতুন মাত্রা
কঠিন আইন থাকার পরেও কমছে না বায়ু দূষণ। দূষণ না কমার মূল কারণ হচ্ছে মেগা প্রজেক্টগুলো করতে গিয়ে যে খোঁড়াখুঁড়ি করে তা কোনোরকম নিয়ম মেনে, পরিবেশ সংরক্ষণ করে করা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী তা করতে তারা বাধ্য।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী শিল্প-কারখানা দূষণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে। অনেক সময় জরিমানা এক লক্ষ টাকা থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু মেগা প্রজেক্ট, ওয়াসা, ডেসকো, তিতাস যে প্রতিনিয়ত দূষণ করে আসছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র আবারও হয়ে উঠুক সমাজ বদলের হাতিয়ার
যারা প্রকল্পগুলো পরিচালনা করেন ও এদের মনিটর করেন উভয়েরই দায়িত্ব আছে। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। আমাদের প্রত্যাশা সবাই যে যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করবে। প্রয়োজনে এই দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করতে হবে।
মেগা প্রকল্পগুলো যারা বাস্তবায়ন করছে তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই অতিরিক্ত মুনাফা চায়। হাইকোর্টেরও নির্দেশনা অনুযায়ী বায়ু দূষণ কমাতে পানি ছিটানো কথা বলা আছে। তারা যদি প্রকল্প এলাকার বাতাসে এবং মাটিতে নিয়মিত পানি ছিটিয়ে যায় তাহলে এই ধুলোগুলো মাটিতে পড়ে যায় এবং এই ধুলোবালি অন্যান্য জায়গায় বিস্তৃত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
আরও পড়ুন : ঢাকার বিষবায়ু কতদিন টানতে হবে?
কোনো ব্যক্তি একটি ভবন ভাঙলে বা নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন করলে যদি চারদিকে চট দিয়ে তা ঘেরাও করে তাহলে তো কম ধুলা যাবে। এসব নতুন এবং আসন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য যুগোপযোগী ও দূরদর্শী নীতি প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা উচিত, উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে তবে এর সঙ্গে পরিবেশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : ড. কবিরুল বাশার
অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়