মো. আবুসালেহ সেকেন্দার: ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন, তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয় আসাম, ভারতের আমন্ত্রণে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত উপর্যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় অল্প সময়ের মধ্যেই নাম করেছে সারা ভারতে। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয় আসামের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় গোয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়িয়ে ওই অঞ্চলের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় অবদান রাখার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী সময়ে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের পঠন পাঠনও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে।
আরও পড়ুন : স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই
শহর থেকে বহুদূরে প্রতিষ্ঠিত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ আমায় মুগ্ধ করেছে। সম্পূর্ণ আবাসিক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, আবাসন সুবিধাসহ নানা সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত আছে। একজন গবেষক নিশ্চিত মনে তার গবেষণা কাজটি যেন করতে পারেন তার সব সুযোগ সুবিধা ওই বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করেছে। ইদানিং বুয়েটে অমন সুযোগ সুবিধা প্রচলন করা হলেও বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় “স্কলার” শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। অফিস রুমে, আবাসিক এলাকার পরিচয়ে স্কলার শব্দটি ব্যবহৃত হওয়া সাদা চোখে স্বাভাবিক ঘটনা মনে হলেও এর একটি অন্তনির্হিত মাজেজা আছে। যতবার নানা উপলক্ষে স্কলার শব্দটি চোখে পড়ছে আমার অন্তত আলাদা অনুভূতি কাজ করছে। মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের কারিগররা নিজের অজান্তেই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্মরণ করাতে এমন শব্দের খেলা খেলেছে। স্কলার শব্দটি যতবার শিক্ষক শিক্ষার্থীরা দেখবে ততবার অনুপ্রাণিত হবে, নিজেকে স্কলার হিসেবে গড়তে সদাপ্রস্তুত করবে। যিনি নামকরণগুলো করেছিলেন তার মনে হয়তো এমন দর্শন কাজ করেছিল। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সচারাচর অমন স্কলার বা গবেষক শব্দের ব্যবহার চোখে পড়ে না।
ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকদের আলাদা কক্ষ আছে। সত্যি অমন সুবিধা গবেষকদের গবেষণার জন্য অতি প্রয়োজন। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গবেষকদের পাঠ ও গবেষণার জন্য আলাদা কক্ষ থাকলেও বিভাগগুলোয় গবেষকদের বসার কোনও জায়গা নেই। পিএইচডি ও এমফিল গবেষকদের তাই বাসায় বসে গবেষণার কাজ করতে হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে গবেষকদের অমন সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষক ও গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়তে নতুন ক্যাম্পাসকে তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইউরোপীয় মডেলে সাজাতে পারে।
আরও পড়ুন : ২০২৩ সাল হবে খুব কঠিন
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সংক্রান্ত কাজের সূত্রে ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর মনে হয়েছে আমি যেন ইউরোপের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ফ্যাসিলিটিসহ নানা সুযোগ সুবিধা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনীয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সচারাচর তা চোখে পড়ে না। যদিও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এখনও গড়ে উঠছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামনে অমন সুযোগ আছে। তাই গবেষণা বান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়তে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনই পরিকল্পনা করা দরকার।
তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটি বিষয় ভালো লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কর্তৃপক্ষ জনসমাগম থেকে দূরে রেখেছে। ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অপ্রয়োজনীয় প্রবেশ তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে।
গতকাল সন্ধ্যার কিছুপরে গেস্ট হাউজ থেকে সামনের রাস্তায় এসে দেখি একজন মধ্য বয়সী লোক এক যুবককে তুলোধুনো করছেন। যুবক বারবার সরি বলছে। ওই যুবকের সঙ্গে এক তরুণী। মধ্যবয়সী লোক তার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলছে। পাশে উপাচার্যের বাসভবন। বাসভবনের শেষপ্রান্ত ও গেস্ট হাউজের মাঝের রাস্তায় পোশাক পরা নিরাপত্তা প্রহরী। উৎসুক হয়ে তার কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। যুবক বাইরে থেকে এসেছে। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে বাইরের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারে না। প্রবেশের জন্য অনুমতি লাগে। কিন্তু যুবকটি অনুমতি ছাড়া ছাত্রীর সহায়তায় ঢুকে পড়েছে। বিষয়টি নজরে আসতেই পদক্ষেপ নিয়েছে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ।
গতকাল হেড অব ডিপার্টমেন্ট বলছিলেন, ক্যাম্পাসের সাথে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া কারোর ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি নেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এলাকাবাসীও প্রবেশ করতে পারে না। প্রবেশ করতে হলে অনুমতি নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে হয়।
আরও পড়ুন : বেড়েছে টিকিট বিক্রি, আয় ১২ লাখ
বিশ্ববিদ্যালয়ের অমন পরিবেশ গবেষণার জন্য সহায়ক। জ্ঞানচর্চার জন্য গবেষণার জন্য অমন ক্যাম্পাসই আসলে প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মনে হয় হাট বাজার, দর্শনীয় স্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বড় প্রমাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা না হয় বাদ দিলাম, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনভাবে সাজানো যেত। কিন্তু কেন যেন হয়নি!
নতুন যে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, ওইগুলোর ক্ষেত্রে এমন নিয়ম চালু করা যেতে পারে। এমনকি জনবহুল এলাকায় অবস্থিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এখনও অমন পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। ক্যাম্পাসের মধ্যে পাবলিক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের অপ্রয়োজনীয় প্রবেশ রুখে কিছুটা হলেও ক্যাম্পাসের পরিবেশ ফেরানো সম্ভব। আর শহরতলীতে অবস্থিত হওয়ায় অন্যবিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে গবেষকদের জন্য কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়।
সবাই নিশ্চয় এই বিষয়ে একমত হবেন যে গুলিস্তানের হর্কাস মার্কেট গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে কিন্তু ওখানে বসে গবেষণা হবে না।
দুই.
তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অপ্রয়োজনীয় প্রবেশে কঠোরতা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে মেয়েদের হলে সান্ধ্য আইন জারি থাকলেও এখানে নেই। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মেয়ে বা ছেলে হিসেবে নয়, এখানে তাদের মানুষ হিসেবে দেখা হয়। মেয়েদের হলে সান্ধ্য আইন জারি নেই। হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট বলছিলেন, সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের মতো ছিল, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আটকে রাখা যাবে না। কেউ কোনও সম্পর্কে জড়াতে চাইলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অবাধ সুযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কাউকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে চোখে রাখা সম্ভব নয়। বরং ছেলে মেয়েরা একত্রে চলার সুযোগ পেলে একে অপরকে সহজে বুঝতে পারবে। পরস্পর পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে। ইউরোপের আদলে ছেলে মেয়েদের আলাদা হল না করে একটি হলে সবার থাকার ব্যবস্থা করার চিন্তাও তার ছিল।
আরও পড়ুন : কূটনীতি হবে ইকোনমিক
বাংলাদেশের মতো দেশে অমন চিন্তা করা অসম্ভব। জনপরিসর এখনও তৈরি হয়নি। ভারতের জনপরিসর এক্ষেত্রে চিন্তার দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে তা বলা যায়। আমি ইউরোপে যখন পড়েছি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ডরমিটরিতে থেকেছি সেখানে ছেলে মেয়ে বলে কোনও পার্থক্য করা হয়নি। সব জেন্ডারের শিক্ষার্থীদের বাস ছিল একই ডরমিটরিতে। অমন পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণ গোঁড়াপন্থীরা চিন্তা না করতে পারলেও আমার অভিজ্ঞতা বলছে, সবস্তরে বৈষম্যের অবসান চাইলে সবার আগে উচ্চশিক্ষিতদের জেন্ডার ভিত্তিক বিভাজনের শিক্ষা না দিয়ে মানুষকে সর্বপ্রথম মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অমন দৃষ্টির চর্চা হলেই সবস্তরে বৈষম্যের অবসান হবে।
তিন.
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা ক্যাম্পাসের কোথাও লেখা আছে বলে আমার চোখে পড়েনি। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতেই একটি বোর্ড দেখে ভালো লাগলো। ওই বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লেখা আছে। ওই বোর্ড লেখা আছে, বিশ্বের সেরা ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া তাদের ভিশন ও মিশন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে প্রতিদিন শিক্ষক, শিক্ষার্থী গবেষদের ওই লেখা চোখে পড়ে, ওই বোর্ডের লেখাগুলো যেন কথা বলে, স্বপ্ন দেখায়। আমার কাছে বিষয়টি দারুন লেগেছে। আগে স্বপ্ন দেখতে হয়, দেখাতে হয়, তারপর ওই ভিশন মিশনে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয় যেন স্বপ্ন দেখানোর ওই কাজটি করছে।
আরও পড়ুন : ডেঙ্গুতে মৃত্যুশূন্য বছরের প্রথম দিন
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা গবেষণার দিকে আগ্রহী না হয়ে বিসিএস পরীক্ষায় আগ্রহী হওয়ার কারণ তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই বড় ভাই বোনদের বিসিএস গাইড পড়তে ব্যস্ত থাকতে দেখে। গবেষক হওয়ার কোনও ভীষণ ও মিশন তাদের সামনে নেই। সুতরাং গবেষক হওয়ার বদলে প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের পড়ায় তারা ব্যস্ত হবে এমনটি স্বাভাবিক। তাই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের চোখে গবেষক হওয়ার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার নতুন মন্ত্র জপার কথা ভাবা দরকার। গবেষকদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বপ্নাতুর করে তুললেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন গবেষক তৈরি করতে পারবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।