মো. জাকির হোসেন: শিরোনামটি আমার নয়, ধার করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তারই অংশ এই শিরোনাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম এবং এর অনেক পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের দেখলে বা তাঁদের কথা শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসতো। কিন্তু ইদানীং কিছু উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। আপনাদের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, কিছু সংখ্যক অসাধু লোকের কর্মকাণ্ডের জন্য গোটা শিক্ষক সমাজের মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একজন উপাচার্যের মূল দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, পরিচালনা, মূল্যায়ন ও উন্নয়নকে ঘিরে। কিন্তু ইদানীং পত্রিকা খুললে মনে হয়, পরিবার-পরিজন ও অনুগতদের চাকরি দেওয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে প্রশাসনিক ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়াই যেন কিছু উপাচার্যের মূল দায়িত্ব। অনেক শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাকে ঐচ্ছিক মনে করেন। বৈকালিক কোর্স বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়াকেই তাঁরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। ছাত্র-শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের সঙ্গে এটি খুবই বেমানান।’
আরও পড়ুন: উন্নয়ন না দেখলে চোখের ডাক্তার দেখান
আর কিছু সংবাদে আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি নিজেই লজ্জায় পড়েন বলে উল্লেখ করেছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি শিক্ষকসহ যেকোনও নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়ার জোর তাগিদ দেন। রাষ্ট্রপতি যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন হাততালি ও হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান উপস্থিত স্নাতকরা। তার মানে রাষ্ট্রপতি শিক্ষার্থীদের মনের কথাটি বলার কারণে তারা এতটাই খুশি হয়েছেন যে কেবল হাততালি নয়; হর্ষধ্বনিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি অনুভব করি এটি কতটা লজ্জা আর অপমানের।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত করার খুব কমই অবকাশ রয়েছে। পত্রপত্রিকার বরাতে জানা যায়, ইউজিসি ২১ জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছেন। এরমধ্যে ১৩ জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। বাকি ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। আমার মতে সংখ্যাটি আরও বেশি হবে। ইউজিসির কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না যাওয়ার কারণে হয়তো কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় তদন্তের বাইরে রয়েছে।
দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির ভয়ংকর চিত্র বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ইসলামী, খুলনা, শেরেবাংলা কৃষি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি, খুলনা কৃষি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের উপাচার্যরা কেউ বিশেষ ভাতা, কেউ বা দায়িত্ব ভাতার নামে বেতনের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ হারে অর্থ নিচ্ছেন। বাংলো থাকার পরও কিংবা বাংলোতে বসবাস সত্ত্বেও উপাচার্যকে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় চট্টগ্রাম, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ, ইউজিসির উল্লিখিত অনুসন্ধানে কেবল অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি বেরিয়ে এসেছে। এর বাইরে নিয়োগ, নির্মাণ, সংস্কারসহ আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম আছে। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আয় বাজেটে দেখানো হয় না। এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় এবং টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের বড় একটি খাত হচ্ছে ঢাকায় রেস্টহাউজ বা লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন। উপাচার্যরা ঢাকার বাইরে না যাওয়ার লক্ষ্যে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে এগুলো স্থাপন করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে একশ্রেণির ভিসি প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে যে উপাচার্যরা এতটাই বেপরোয়া যে তাঁদের সরকার স্পর্শ করতে পারবে না এমন কথাও প্রকাশ্যে বলে থাকেন।
আরও পড়ুন: ইউক্রেনে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ৬০ লাখ মানুষ
কেন এমন হচ্ছে? মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যেই তার উল্লেখ রয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এর সহজ মানে হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। আর নেই বলেই তো নানা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে ’৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যরা এতটাই ক্ষমতাধর যে তাঁদের ক্ষমতা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতা বুঝাতে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে , ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নারীকে পুরুষ আর পুরুষকে নারী বানানো ব্যতীত সবই করতে পারে’।
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে যা-ই থাকুক, বাস্তবে স্বায়ত্তশাসনের নামে আসলে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও তাদের পারিষদবর্গের শাসন চলে। নিয়োগ পাওয়ার পর উপাচার্য মহোদয় প্রথমেই খুঁজে বের করেন এমন সব শিক্ষক-কর্মকর্তাকে যাঁরা তাঁর সকল কাজে শতভাগ আনুগত্য প্রদর্শন করবেন। এরপর তিনি এই অনুগতদের বিভিন্ন পদে বসান। পরিবর্তন আনেন বিভিন্ন নিয়োগ বোর্ডে, তাতেও নিজের পছন্দের লোকদের নিযুক্ত করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি সিন্ডিকেট, সিনেটসহ সব পর্ষদে শতভাগ অনুগত লোকদের নিযুক্ত করার যাবতীয় কৌশল প্রয়োগ করেন। বিভিন্ন পর্ষদে রাষ্ট্রপতির কোটায় মনোনয়নের জন্য যাদের তালিকা পাঠানো হয় তারাও উপাচার্যের একান্ত পছন্দের ব্যক্তি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও তাদের পরিষদবর্গের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অঙ্গুলি হেলনে। আর এভাবেই তৈরি হয় জবাবদিহিহীন ভয়ংকর এক পরিবেশ।
এমন পরিবেশেই তো দুর্নীতির বিষবৃক্ষ পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়ে প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে। এমন বৈরী পরিবেশে নীতি-নৈতিকতা শ্রীহীন হয়ে পড়ে। দুর্নীতি, অন্যায়, অনিয়ম, অনাচার, অনৈতিকতা সংক্রামক ব্যাধির মতো। দ্রুত প্রতিরোধ করা না গেলে তা বাড়তেই থাকবে। কোনও কোনও উপাচার্য মূল্যবোধের এত নিচে নেমে যাচ্ছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনতম মানদণ্ড ধ্বংস করে ফেলছেন। পরবর্তী উপাচার্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা ভয়ানক কঠিন হয়ে পড়বে। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বিবিসি বাংলাকে জানান, ভিসিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে ৮০ ভাগের বেশি আর্থিক বিভিন্ন বিষয় ও অনিয়ম নিয়ে। আর বাকি যেসব অভিযোগ আসে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে। তিনি জানান, নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পছন্দের প্রার্থীর জন্য নিয়োগের নিয়মকানুন শিথিল করা হচ্ছে। আবার যে যে পদের যোগ্য নয়, তাকে সে পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই যে উপাচার্যরা নানা অনিয়ম-দুর্নীতি-অপকর্ম-অপরাধ করছেন তা কি কেবল একক ক্ষমতায় করা সম্ভব? উত্তর, অবশ্যই না।
আরও পড়ুন: সময় হলে অ্যাকশনে যাবে বাংলাদেশ
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তা এসব দুষ্কর্মের সহযোগী না হলে উপাচার্যরা কখনোই এককভাবে এসব অন্যায়-অপরাধ করতে পারতেন না। নিয়োগ বোর্ডে উপাচার্য ছাড়াও অন্য শিক্ষকরা থাকেন। জিপিএ হ্রাস করাসহ নিয়োগের নিয়ম-কানুন শিথিল করার কমিটিতেও শিক্ষকরা থাকেন।
শিক্ষকরা কীভাবে উপাচার্যের অপরাধ কর্মের সহযোগী হন সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে, এমনকি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন উপাচার্যের ছুটিতে থাকা দিনগুলোতে অন্তত ছয়টি পরীক্ষায় উপাচার্যকে উপস্থিত দেখিয়ে ভর্তি পরীক্ষার পরিদর্শন বাবদ সম্মানি পরিশোধ করেছেন। আর উপাচার্যও তাতে স্বাক্ষর করে সম্মানি গ্রহণ করেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, উপাচার্য কি বিদেশ থেকে ফিরে এই বেআইনি সম্মানি দাবি করেছিলেন, নাকি উপাচার্যের আরও প্রিয়ভাজন হতে ডিন মহোদয় নিজে থেকেই চাটুকারিতার নামে অপরাধের সহযোগিতা করেছেন?
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টরা একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অস্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক বিবেচনা ও তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগসহ নানা জটিলতার কারণে যোগ্য ব্যক্তিরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন না। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদের নিয়োগ দেওয়া দরকার।
উপাচার্যদের ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ, অতীত ইতিহাস দেখা দরকার। ব্যক্তিত্ব থাকলে অবশ্যই আইন মেনে চলবেন। তিনি বা তার পরিবার লোভী কিনা তা দেখা দরকার। তাছাড়া তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা যা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সাহায্য করবে তা থাকা দরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত করতে গিয়ে আমার এই বিষয়গুলোই মনে হয়েছে।’
আরও পড়ুন: মৃত্যুতে শীর্ষে ব্রাজিল
উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই বিষয়গুলো মানা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেখান থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় সেখানে এই বিষয়গুলো তেমন ভালোভাবে মানা হয় না।
বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিক্ষাবিদরা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনাগুলো ঘটে থাকে- কারণ উপাচার্য তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনও জবাবদিহির জায়গা নেই। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক- এই দুই জায়গায় উপাচার্য এবং প্রশাসনের জবাবদিহি থাকা জরুরি। কিন্তু এটা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্র সংসদ নেই। ছাত্র সংসদের সুবিধা হলো, এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। তারা সতর্ক থাকেন এবং সচেতন থাকেন যে শিক্ষার্থীরা তাদের দেখছে এবং তারা প্রশ্ন করবে। তিনি বলেন, আরেকটি জবাবহিদির জায়গা হলো শিক্ষক সমিতি। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সমিতি থাকলেও তারা এসব বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তোলে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউজিসি সদস্য একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, ‘পরিণতি যদি কিছু না হয়, যেমন তদন্ত হচ্ছে কিন্তু কোনও ফল হচ্ছে না বা শাস্তি হচ্ছে না তাহলে আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তিদের কোনও ভয় থাকে না। অনেক সময় সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। উপাচার্যদের দুর্নীতির প্রতিবাদ তেমনভাবে করেন না। শুধু উপাচার্যকে তোষামোদি করে চললে হবে না।’
শিক্ষাবিদরা যথার্থই বলেছেন, অস্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক বিবেচনা ও তদবিরের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ ও উপাচার্য তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহি না থাকার কারণে অনিয়ম, অনৈতিকতা ও দুর্নীতি গ্রাস করেছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। গণতান্ত্রিকভাবে ও জবাবদিহির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু পর্ষদ তৈরি করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিনেট, সিন্ডিকেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, ফিন্যান্স কমিটি, অনুষদের ডিন, বিভাগীয় অ্যাকাডেমিক কমিটি, বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি ইত্যাদি।
এসব পর্ষদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো সিন্ডিকেট। আইনে বলে দেওয়া আছে এটি নির্বাহী অঙ্গ। সিন্ডিকেট বিধি প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাতিল করতে পারে। তার মানে এটি আইনসভার মতো দায়িত্ব পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর অপরাধমূলক কাজের জন্য পদাবনতি, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, জরিমানা, বরখাস্তকরণ ও চাকরিতে অপসারণের ক্ষমতাসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে সিন্ডিকেটের। এই হিসাবে সিন্ডিকেট এক প্রকার বিচারিক দায়িত্বও পালন করে থাকে। ফলে উপাচার্যের অবারিত ক্ষমতা এবং সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন পর্ষদের ক্ষমতার মধ্যে একধরনের ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স, তথা ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পর্ষদকে প্রায় অকার্যকর করে রাখা হয়েছে কিংবা রাবার স্ট্যাম্প তথা সাক্ষীগোপাল করে রাখা হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পর্ষদ কেবল দশকের পর দশক ধরে মেয়াদোত্তীর্ণই নয়, অনেক পর্ষদের অধিকাংশ পদ বছরের পর বছর ধরে শূন্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নিয়ে গত কয়েক মাসে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শতাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ১৬ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এই ১৬ জন সদস্যের মধ্যে থাকবেন – পদাধিকার বলে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য, ৬ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি, যাদের মধ্যে চার জন শিক্ষকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং অন্য দু’জন ডিন ও প্রভোস্টদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন, সিনেট মনোনীত একজন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ও একজন শিক্ষাবিদ, আচার্য মনোনীত ৩ জন প্রতিনিধি, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল মনোনীত একজন প্রতিনিধি, সিনেট মনোনীত একজন বিশিষ্ট নাগরিক, সচিব মর্যাদার নিচে নন সরকার মনোনীত এমন একজন প্রতিনিধি।
আরও পড়ুন: মহিলা লীগের সম্মেলন দুপুরে
সিন্ডিকেট সদস্যের মেয়াদ দুই বছর। ১৬ সদস্যের সিন্ডিকেটে ৬ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি, একজন শিক্ষাবিদ ও একজন বিশিষ্ট নাগরিকের পদসহ ৮টি পদ বছরের পর বছর ধরে শূন্য রয়েছে। যে ৮ জন সদস্য রয়েছেন তার মধ্যে একজন তিন দশকেরও বেশি সময় এবং একজন ৫ বছর যাবৎ সিন্ডিকেট সদস্য আছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনগত বাধ্যবাধকতা ও বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও উপাচার্য মহোদয় নির্বিকার রয়েছেন। অথচ, বাংলাদেশ ও ভারতের আদালত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার আদেশ দিয়েছেন অসংখ্য মামলায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করায় পরিচালনা কমিটি ভেঙে দিয়ে আদালত নিজেই প্রশাসক পরিষদ নিয়োগ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন।
Indian Olympic Association (IOA)মামলায় দিল্লি হাইকোর্ট অলিম্পিক কমিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে গড়িমসি করায় কমিটি ভেঙে দিয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি Justice Anil R. Dave, সাবেক নির্বাচন কমিশনার SY Quraishi এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব Vikas Swarup- কে নিয়ে প্রশাসক পরিষদ গঠন করেন এবং ১৬ সপ্তাহের মধ্যে আবশ্যিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আদেশ প্রদান করেন।
All India Football Federation (AIFF)-এর সভাপতি Praful Patel-এর নেতৃত্বাধীন কমিটি নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠান না করায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কমিটি অপসারণ করে কাউন্সিল অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস নিয়োগ করেন। আদালত ২৭ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেন। Alam Singh v. Additional Director of Education মামলায় একটি কলেজের পরিচালনা পর্ষদ নির্ধারিত মেয়াদ অবসানের পরও নির্বাচন অনুষ্ঠানে টালবাহানা করায় উত্তরাঞ্চল হাইকোর্টের বিচারপতি Manoj K. Tiwari নির্দেশ প্রদান করেন যে তিন সপ্তাহের মধ্যে ভোটার তারিকা প্রণয়ন ও ভোটার তালিকা তৈরির দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। নির্বাচনের ফল প্রকাশের ৭ দিনের মধ্যে নতুন পরিচালনা পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের সময়সীমাও বেঁধে দেন আদালত।
ভারতের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অজুহাতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিবর্তে মনোনয়নের মাধ্যমে গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে আদালত তা নাকচ করে দেন। উদাহরণস্বরূপ, Gunjan Kumar Sinha vs State Of Chhattisgarh, K Saktheenath, Principal of Elija College, D L S P G মামলার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে Bangladesh Association of International Recruiting Agencies (BAIRA) মামলায় সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে BAIRA–র এক্সিকিউটিভ কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠানের আদেশ দেন।
আরও পড়ুন: পাবনায় ঋণের দায়ে ১২ কৃষক গ্রেফতার
Bangladesh Jewellers’ Association (BAJUS)এর মামলায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৯ সালে ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট BAJUS এক্সিকিউটিভ কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠানের আদেশ দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ায় আমাদের সর্বোচ্চ আদালত একে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করে বাতিল করে দেন। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিভিন্ন পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও কোনও কোনও উপাচার্য নির্বাচন না করে অতি গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদের সদস্যপদ বছরের পর বছর শূন্য রেখেছেন। জবাবদিহি এড়ানো ছাড়া আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে এর পেছনে? মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তাহলে কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে?
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়