মো. কামাল হোসেন: বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আগের যুগে নিয়োগ পরীক্ষা হতো, তাই সাংবাদিকতার মান ছিল উঁচু, আর আজকাল ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও আত্মীয়তার সম্পর্কই নিয়োগের প্রধান অলিখিত শর্ত, ব্যক্তির মেধা ও পেশাগত যোগ্যতা নিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় কাজে লাগে না, বরং মেধা ও অভিজ্ঞতাই কোনো কোনো ব্যক্তির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন: সাংবাদিকদের জন্য নতুন শান্তনা পুরষ্কার ‘হাইকোর্টকে ধন্যবাদ’
এছাড়া নিয়োগকারী ব্যক্তিরা মনে করে ভালমানের মেধাবী ও অভিজ্ঞ গণমাধ্যমকর্মীকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না! তবে বর্তমান সময়ে আলোচিত-সমালোচিত একটি বিষয় হলো, বেশিরভাগ গণমাধ্যমের জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন নিয়োগ ও বিজ্ঞাপন ‘বাণিজ্য’ এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। বলা যায় গণমাধ্যমে সুস্থ ধারার বিপরীতে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট (অপশক্তি) গড়ে উঠেছে।
তবে ইদানিং কিছু হাউজে নিয়োগ পরীক্ষা হয় বটে, কিন্তু তা শুধুই মালিকপক্ষকে বুঝানোর জন্য, নয় তো এইচআর বিভাগের প্রয়োজনীয়তা মালিক পক্ষের কাছে থাকবে না হয় তো। বেশ কয়েক বছর যাবৎ বেশ কয়েকটি কথিত বড়-বড় গণমাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষার নাটক দেখেছি। এতে ওই গণমাধ্যমগুলোর একটি নিয়োগ বিজ্ঞাপন দিলে হাজার-হাজার আবেদন জমা পড়ে, আর ওই সকল আবেদন শুধু পড়ে দেখার জন্য উক্ত হাউজগুলোতে এইচআর বিভাগের যে পরিমান লোকবল আছে, তাতে ওই আবেদনগুলো শুধুমাত্র পড়ে দেখতেই যুগ পেরিয়ে যাবে!
তবে এতে বিকল্প পদ্ধতিও রয়েছে, তা হলো রেফারেন্সের আবেদনগুলো দেখে আরও কয়েকটি সিভি/আবেদন যুক্ত করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। এতেই মালিকপক্ষকে দেখানো যায়, কয়েক হাজার সিভি/আবেদন থেকে বাছাই করে শ’খানেক আবেদনকারীর লিখিত পরীক্ষা দিয়েছে, তার মধ্যে কয়েকজন উত্তীর্ণ হয়েছে।
আরও পড়ুন: নর্দমায় বাস করছি
আর মোখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেয়ার বেলায় রেফারেন্সের ব্যক্তিরাই নিয়োগ পায়। তাতে এক ঢিলে ‘বহু’ পাখি মারার কেরামতি দেখানো যায়, এতে মালিকপক্ষ তো মহা খুশি দেশের সেরা গণমাধ্যমকর্মী পেয়েছেন তিনি, আর রেফারেন্সের ব্যক্তি খুশি তার পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে তার সিন্ডিকেট পাকাপোক্ত করতে পেরেছেন। আর এইচআর খুশি তার চাকরির নিরাপত্তা রক্ষা হলো!
এতে আবার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিনিয়োগ হলে তাদের লোকজনকে বিশেষ সুবিধা দিতে হয়। ইদানিং একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের নিয়োগ চোখে পড়ার মতো তো বটে, বলা যায় দলটি দেশের গণমাধ্যম নীরবে শুধু বিনিয়োগ ও কৌশলে সিন্ডিকেট করে দখল করে নিয়েছে। আমি হয় তো কথাগুলো একটু আগে বলে ফেললাম। একদিন দেশবাসী দেখবে আগের যুগে গণমাধ্যমের দখল ছিল কথিত বামপন্থীদের দখলে আর এখন কথিত ডানপন্থীদের দখলে চলে গেছে। সত্য বলা এদেশে অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। তাই বিষয়টি সবাই জানলেও বলতে চান না। এটি নিয়ে আরেকদিন কিছু বলব।
আরও পড়ুন: বর্ণ বৈষম্যের দেশে হিরো আলম
এখন মূল বিষয়ে আসি, নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে যা বলছিলাম, মৌখিক নামের পরীক্ষা তো আরেক আজব কাহিনি, সেখানে যাকে নিয়োগ দেয়া হবে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তার নাম কি, দেশের বাড়ি কোথায়, আর এই বেতনে করবে কিনা, আর না নিলে ওই আবেদনকারীকে জিজ্ঞাসা করা ‘মঙ্গল গ্রহের মাটির রং কি?’ ‘বারমুদা টায়াঙ্গলে কত কোটি লিটার পানি আছে?’র মতো উদ্ভট-উদ্ভট প্রশ্ন।
আবার অনেকের প্রশ্ন করার ভাব দেখলে মনে হয়। তিনি পৃথিবীর সেরা জ্ঞানী সাংবাদিক, কিন্তু তিনি জীবনে কোনো নিউজ করেছেন বা এডিট করেছেন কিনা খুঁজে পাওয়া না পেলেও ওই ব্যক্তিদের ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইনে কয়েক লাইনের স্ট্যাটাসে হাজারও ভুল পাওয়া যায় অনায়াসে। এতে আঁতেল চিনতে অসুবিধা হয় না। এছাড়া বেশিরভাগ দামীদামিসহ কথিত বড়-বড় গণমাধ্যমের অনলাইনে করানো হয় কপি-পেস্ট আর টুকটাক এডিটসহ একদিনে কতগুলো নিউজ দেয়া যায় তার প্রতিযোগিতা। ব্যক্রিক্রমও আছে, তবে তা হাতে গোনা কয়েকটি হবে হয় তো।
আরও পড়ুন: খুনিদের যুদ্ধে পাঠাচ্ছেন পুতিন!
একটি অভিজ্ঞার কথা বলি শুনেন, কয়েকদিন আগে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ পেতে এক ব্যক্তির সাথে দেখা করতে গেলে, তিনি জানান, আগে যিনি ছিলেন, তিনি নাকি দিনে ৩০-৩৫টি নিউজ দেন। আমি পারবো কি না? তার কথা শুনে ওই (ক্রাইম রিপোর্টার) ব্যক্তি নিজেই নিউজগুলো করে কিনা তা জানার ইচ্ছা মরে গেলেও জানতে ইচ্ছা করছিল, যিনি দিনে ৩০-৩৫টি নিউজ দেন, তিনি কি ওই পরিমান নিউজ একদিনে কখনও পড়ে দেখেছেন কিনা?
তবে এই ধরণের আঁতেল মানুষেরা সাধারণত মালিকপক্ষের অতি প্রিয়পাত্র হয়ে থাকেন। এর অন্যতম কারণ সাধারণ বাজারে দাম বাড়লেও ‘তেল’ দিতে পারেন বলে। অনেক জায়গায় তো টাকা-পয়সাসহ ভিন্ন কিছু বিনিময়ের গুঞ্জনও শুনা যায়! সেগুলো বলতে গেলে ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে হয় তো।
আরও পড়ুন: এমপি নির্বাচন করব
আরেকটি ব্যাপার বলি, এদেশের গণমাধ্যমের নিয়োগ পরীক্ষা অনেকটা মাষ্টার্স (গণমাধ্যমে কাজের উপযোগী মেধাবী ব্যক্তি অর্থে বুঝানো হয়েছে) পাশ লোককে পরীক্ষা দিতে হয় ডিগ্রি পাশ বার তার নিচের ধাপের (ধরুন এইচএসসি-এসএসসি মানের) লোকের কাছে, আর খাতাও দেখেন তারা। এতে নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ/ফেল দেখানও তারা! আর নিয়োগ পেতে মাষ্টার্স পাশ লোককে রেফারেন্স/তদবির নিতে যেতে হয়ে এইট পাশ লোকের কাছে। অনেকটা সরকারি চাকরি পেতে মেধাবী ব্যক্তিদের এইট পাশ চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ জনপ্রতিনিধির কাছে গিয়ে তদবির করার মতো।
পরিশেষে একটি বিষয়ে কিছু বলতে চাই, তা হলো অনেক টাকা বিনিয়োগ করেও ভাল লাভজনক ও পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত করাতে ব্যর্থ মালিকপক্ষের প্রতি করুণা নয় বরং মায়া লাগে এই ভেবে যে, তিনি/তারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিনিয়োগ করেন। কয়েক বছর পরে ঠিকই বুঝতে পারেন তিনি তেলবাজের ধোঁকায় পড়ে অনেক কিছু হারিয়েছেন। তারাই বলেন, সাংবাদিকেরা খারাপ আর গণমাধ্যমে বিনিয়োগ লাভজনক নয়! তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আপনি/আপনারা বিনিয়োগ করেছেন তেল বাণিজ্যে কোনোভাবেই গণমাধ্যমে নয়।
আরও পড়ুন: সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
একই সাথে বাংলা একটি প্রবাদ (গরু দিয়ে হাল চাষ করতে হয়, ছাগল দিয়ে নয়) মনে করিয়ে দিয়ে বলতে চাই সাংবাদিকতা চাইলে ‘তেল’ পাবেন না, আর তেল চাইলে সাংবাদিকতা পাবেন না। একই সাথে মনে রাখবেন কোনো নীতিবান ও ব্যক্তিত্ববোধ সম্পন্ন সাংবাদিক ‘তেল’ দিয়ে মালিকপক্ষকে খুশি করতে পারে না, বরং তার কাজ দিয়ে খুশি করে থাকে, যা পেতেও একই ধরণের ‘মানসিকতা’ থাকতে হবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]
সান নিউজ/কেএমএল